উড়নচণ্ডীর পাঁচালি।। সমরেন্দ্র মণ্ডল।। সুপ্রকাশ

যতদূর মনে পড়ছে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার রাজ্যের ক্ষমতায় এসেছে। স্মৃতি কি একটু বিশ্বাসঘাতকতা করল? হতে পারে। তবে এটা মনে আছে, কয়েক জনের উদ্যোগে কৃষ্ণনগরে পাত্রবাজারে শোভন মুদ্রণী থেকে একটা ট্যাবলয়েড বেরোতে শুরু করে। সংবাদপত্র। সাপ্তাহিক। গ্রাম-গ্রামান্তর। এটুকু মনে পড়ছে এককালীন নকশাল নেতা রামু ব্যানার্জি এই উদ্যোগের সঙ্গে ছিলেন। চার পৃষ্ঠার ট্যাবলয়েড। নিউজপ্রিন্টে ছাপা। প্রকাশক ও মুদ্রক প্রেসের মালিক নীহার বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্পাদনার দায়িত্ব বর্তাল তরুণ কবি ও গদ্যকার শতঞ্জীব রাহার ওপর। (জনান্তিকে বলে রাখি, একসময় শতঞ্জীব বদলে ‘সতঞ্জীব’ করে নিয়েছিল। জিজ্ঞাসার উত্তরে বলেছিল, শত বছর নয়, সৎভাবে বাঁচতে চাই।) আর শতনকে (এই নামেই আমরা ডাকতাম) কাঁধ দেওয়ার জন্য ছিল এই উড়নচন্ডী। আমরা অবৈতনিক। কীসের টানে, কোন মতাদর্শে যে সংবাদপত্র করে যাচ্ছিলাম, কে জানে! কিন্তু, ক্রমশ নেশা হয়ে গেল। সকাল-বিকেল দু-বেলা প্রেসে হাজির। তারই মাঝে খবর সংগ্রহ, টিউশনি, প্রেসে বসে বিস্তর কাজ। লেটার প্রেসের যুগ। হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকি আমরা দু-জন। টিউশনির পয়সায় মুড়ি চিবুই। ক্রমশ শহরের অন্য ট্যাবলয়েডকে পেছনে ফেলে ‘গ্রাম-গ্রামান্তর’ এগিয়ে গেল।

সেইসময়টা ছিল ট্যাবলয়েডের যুগ। কৃষ্ণনগর থেকে বের হত ‘বিদ্যুৎ’। সাপ্তাহিক প্রতিবাদী কাগজ। বাজারে এলেই অমিল হয়ে যেত। রানাঘাট থেকে বের হত ‘চ্যালেঞ্জ’। খুব নাম করেছিল সরকার বিরোধী কাগজ হিসেবে। সেইসময় প্রায় সব শহর থেকেই বের হত ট্যাবলয়েড সংবাদপত্র। কোনোটা সাপ্তাহিক, কোনোটা পাক্ষিক। বীরভূমের সিউড়ি থেকে ‘চন্দ্রভাগা’ খুব নাম করেছিল। পরে তো ‘চন্দ্রভাগা’ দৈনিকও হয়েছিল। তবে বেশিদিন জীবিত থাকেনি। আবার সাপ্তাহিকে প্রত্যাবর্তন করেছিল। সারারাজ্যেই ছিল ট্যাবলয়েডের রমরমা। শহর কলকাতাতে এরকম বেশ কিছু ট্যাবলয়েড ছিল। খুব নাম করেছিল ‘কোলফিল্ড টাইমস’। কলকাতায় হোক, কি মফস্বলে, দৈনিক কাগজের সাংবাদিকরা এইসব ট্যাবলয়েডের পেছনে থাকতেন। বেনামে লিখতেন। তবে ‘গ্রাম-গ্রামান্তর’ এগিয়ে ছিল নিজেদের সূত্র ধরে। গ্রাম পঞ্চায়েতের অনেক বামনেতার অপকীর্তিও ছাপা হয়েছিল। প্রশাসনেও তার প্রভাব পড়ত। ফলে ‘গ্রাম-গ্রামান্তর’ হয়ে উঠল ‘বিদ্যুৎ’-এর প্রতিদ্বন্দ্বী। বাজারে বিদ্যুৎ বিক্রিতে ভাটা এল, এগিয়ে গেল আমাদের কাগজ। ঠিক এই সময় যুব কংগ্রেস নেতা উত্তম গাঙ্গুলি বের করল ‘কৃষ্ণনগর সমাচার’। ছাপা হতে থাকল শোভন মুদ্রণীতেই। আমাদের কাগজ বুধবার, ওদের শুক্রবার। পত্রিকার প্রকাশ সময় ঠিক রাখার জন্য অনেক সময় উত্তপ্ত পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে।

তা, ঠিক সেইসময়ে বিষ্ণু এল প্রেসে। আমি আর শতন বসে কাজ করছি। উদ্দেশ্য, কবিতার পত্রিকা করবে। নীহারদার সঙ্গে কথা বলিয়ে দিলাম আমরা। ষোলো পৃষ্ঠার কবিতার কাগজ। নিউজপ্রিন্টে ছাপা। সেটাই তখন দস্তুর ছিল গরিব কবিদের। নাম দিল ‘উদাহরণ’। শতঞ্জীব লিনোকাটে নামটা খোদাই করে দিল। শতন তখন লিনোকাট ছবি খোদাইয়ের দিকে মন দিয়েছে। ভালো ছবি আঁকত সে। কবিতার পাশাপাশি গল্প লিখত নিয়মিত। ওর গল্পের খাতা ছিল একটা বই। প্রতিটি গল্পের শুরুতে গল্পের ছবি আঁকত। গল্পের শিরোনামও লিখত বিভিন্ন শৈলীতে। তখন গ্রাফিক্সের খুব চল ছিল। তা, বিষ্ণুর ‘উদাহরণ’ বের হতে শুরু হল। শতঞ্জীবই পত্রিকা সাজিয়ে দিত। কয়েকটা সংখ্যা শোভন মুদ্রণী থেকে ছাপা হয়েছিল। তারপর আর বেরিয়েছিল কি না, জানা নেই। কেননা ততদিনে সে সিনেমার দিকে ঝুঁকেছে।

বিষ্ণুর এক দাদা কলকাতায় একটা বড়ো অফিসে কাজ করতেন। সেখানেই চাকরি করতেন ‘দিবারাত্রির কাব্য’ সিনেমার অন্যতম পরিচালক নারায়ণ চক্রবর্তী। দাদার অফিসে যাতায়াতের সূত্রে নারায়ণবাবুর সঙ্গে তার আলাপ হয়ে যায়। অমনি সিনেমার পোকাটা তার মাথায় ঢুকে পড়ে। সে সিনেমার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। একদিকে কবিতা চর্চা, অন্যদিকে সিনেমা নিয়ে পড়াশুনো। মাথায় ঢুকল কবিতা নিয়ে ছবি করবে। শর্ট ফিল্‌ম। শক্তি চাটুজ্জের ‘অবনী বাড়ি আছো’-র চিত্রনাট্য লিখল। বেশ লিখেছিল। সেই পর্বে উড়নচণ্ডীও তাকে দু-চারদিন সঙ্গ দিয়েছিল। ক-দিন সেই চিত্রনাট্য বগলে নিয়ে কলকাতায় প্রযোজকেরও খোঁজ করেছিল। একে নতুন পরিচালক, তার উপর কবিতার ছবি– কে দেবে টাকা? কিন্তু হাল ছাড়েনি সে।

সালটা বোধ হয় ১৯৭৯। কৃষ্ণনগরে এল এক সিনেমা কোম্পানি। তারা ‘গোপাল ভাঁড়’ ছবি বানাবে। পরিচালক অমল শূরের প্রথম ছবি। তিনি অসিত সেনসহ বেশ কিছু খ্যাতনামা পরিচালকের সহকারী ছিলেন। কিছুদিন ছাত্র পড়িয়েছেন স্কুলে, কলেজে। তা, তিনি কৃষ্ণনগরে নাটকের ছেলেমেয়ের খোঁজ করলেন। তাদের দিয়ে অভিনয় করাবেন বলে। এতে একটা সুবিধা, বিনে পয়সায় সব হয়ে যায়। শুটিং হল নাকাশিপাড়ার কাছে। নদিয়ার ওই গ্রামাঞ্চলে ছিল সিংহরায়দের জমিদারি। কৃষ্ণনগর উকিলপাড়ায় তাদের বাড়ি। বড়োছেলে সৌম্যেন হয়ে গেল অমল শূরের সহকারী। সেইসব শুটিং-এর ব্যবস্থা করল তাদের জমিদার বাড়িতে। গোঠপাড়ায়। আমাদের বন্ধু সুবীর সিংহ রায়, মানিক কর অভিনয় করল। ওরা তখন ‘নাট্যচক্র’ দলের অভিনেতা। অভিনয় করল সংলাপ-এর কিশোর বিশ্বাস। মানিক পরেও অমল শূরের ছবিতে অভিনয় করেছে। তা, বিষ্ণু সেই দলে ভিড়ে গেল। সিনেমার শুটিং শেষ হওয়ার পর অমল শূরের সঙ্গে সৌম্যেন আর বিষ্ণু টালিগঞ্জে পা রাখল। হয়ে গেল পুরোদস্তুর সিনেমার মানুষ। সিনেমার কাজ শিখতে লাগল।
কিন্তু, সে তো আর একজায়গায় থাকার মানুষ নয়। নিজেকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায়। ভিতরে ভিতরে সিনেমার খিদেটা বাড়ছে। খুঁজছে আরও ভালো গুরু। পেয়েও গেল। পার্থপ্রতিম চৌধুরী। তাঁর কাছেই চলে গেল। এই পার্থপ্রতিমই ছিল তার প্রকৃত গুরু। সর্ব অর্থে। কিন্তু, পার্থপ্রতিম তো তখন নিয়মিত ছবি করছেন না। অর্ধেক হয়ে পড়ে থাকছে। তখন বোধ হয় ‘কৃষ্ণপক্ষ’ বা ‘ক্যানভাস’-এর কাজ চলছিল। ছবি দুটি বাজারের মুখ দেখেনি। কিন্তু, নিয়মিত ছবি না হলে তো টাকা পাবে না, পেট চলবে না। ফলে, অন্য পরিচালকদের সঙ্গেও কাজ করতে হচ্ছে। কলকাতায় বাসা ভাড়া করে থাকা, বিয়েও করে ফেলেছে। সুতরাং, রোজগারটা তো করতে হবে। টলিউডে বেশ নাম করল। কাজ করল সৈকত ভট্টাচার্যর সঙ্গে। ‘দুলিয়া’ ছবিতে প্রথম সহকারী। পাশাপাশি বিজ্ঞাপনের ছবি করতে শুরু করেছে। এভাবেই একদিন গিয়ে পৌঁছোল দূরদর্শনে। ততদিনে কবিতা সরে গেছে অনেকটা। বোধ হয় অভিমানে। মনের মধ্যে সিনেমার পোকাটা অবিরাম বকাঝকা করে চলেছে– সিনেমা কর, সিনেমা কর।
কলকাতায় চালু হল ডি ডি বাংলা। শুরু হল বাংলা ধারাবাহিক। বাংলা ধারাবাহিকের প্রথম যুগ। নাট্যকার পরিচালক জোছন দস্তিদার করলেন ‘তেরো পার্বণ’। সাড়া পড়ে গেল। সেটা গত শতাব্দীর আটের দশকের শেষের দিকে। তখন দূরদর্শনের নিয়ম ছিল প্রতিটি ধারাবাহিক হবে তেরো পর্বের। এখনকার মতো এত চ্যানেলও ছিল না। সরকারি চ্যানেল, ফলে বিষয় নির্বাচনেও সতর্ক থাকতে হত পরিচালকদের। পরিচালনায় এলেন তপন সিংহ, ঋতুপর্ণ ঘোষ, গৌতম ঘোষ। বাংলা ধারাবাহিককে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিলেন। ঠিক এই সময় বিষ্ণুও এই ধারাবাহিকের খাতায় নাম লেখাল। সম্ভবত ‘পিতা পুত্র’ ছিল ওর তৈরি প্রথম ধারাবাহিক। মনোজ মিত্রর চিত্রনাট্য। এরপর একে একে আরও কয়েকটা তেরো পর্বের ধারাবাহিক করল। দূরদর্শনের পাশাপাশি বেসকারি চ্যানেলেও করেছিল। ক্রমশ সে কবিতার উঠোন থেকে সরে গেছে ক্যামেরার উঠোনে। একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, কবিতা লেখা কি ছেড়ে দিলে?

ওর সস্মিত উত্তর, কেন, লিখছি তো! সব কবিতা এখন সিরিয়ালে।
............................................
উড়নচণ্ডীর পাঁচালি
সমরেন্দ্র মণ্ডল

প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল
মুদ্রিত মূল্য : ৩০০ টাকা
...........................................
সুপ্রকাশ প্রকাশিতব্য।

Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম।। অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। সুপ্রকাশ।।

চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে।। অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।