উড়নচণ্ডীর পাঁচালি।। সমরেন্দ্র মণ্ডল।। সুপ্রকাশ।।
হ্যাঁ, অল্পস্বল্প আলাপ হয়েছিল সিনেমাপাড়াতেই। কোনো এক সিনেমার শুটিং পর্বেই আলাপ। খুব মিশুকে লোক ছিলেন তিনি, জমিয়ে আড্ডা দিতে পারতেন। বললেন, ‘তুমি তো বসুশ্রী কফি হাউসে বসো।’
বললাম, ‘হ্যাঁ।’
তখন রবিবার সকালে আমি, তরুণ চৌধুরী আর কয়েক জন বসুশ্রী কফি হাউসে বসতাম। শিয়ালদার বোর্ডিং হাউসে থাকি তখন। ওই বসুশ্রীতেই অন্যপাশে অনিল চট্টোপাধ্যায় বসতেন কয়েক জন সিনেমা-লেখকের সঙ্গে। তাঁরা সিনেমা সমালোচনা ছাড়াও তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে লিখতেন। তবে, সিনেমাপাড়ার সঙ্গে তেমন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না। ওখানেই তিনি দেখেছিলেন আমাকে।
শুটিং-এর ফাঁকে কথা বলতে বলতে বেশ জমে গেল। আসলে, তিনি তো ছিলেন আড্ডাবাজ। তবে, মাঝেমধ্যেই তিনি উধাও হয়ে যেতেন। চলে যেতেন ঘাটশিলায়। ওখানে ‘বিভূতিভূষণ স্মৃতিরক্ষা কমিটি’র সভাপতি ছিলেন। সিনেমাপাড়ার শিল্পী-কলাকুশলী সংগঠনেরও তিনি শীর্ষে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চলচ্চিত্র উন্নয়ন পর্ষদের শীর্ষেও বোধ হয় ছিলেন বেশ কিছুদিন। এত সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে থেকেও কিন্তু মানুষটা এক-শো ভাগ ছিলেন সিনেমার মানুষ।
কয়েক দিনের আড্ডাতেই তিনি জেনে নিলেন আমার হাল-হকিকত। আমিও যে উড়নচণ্ডী, সেটা জেনে বললেন, আমিও তো উড়নচণ্ডী। এখন তো আর হবে না, নাহলে সব ছেড়েছুড়ে কাঁধে ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। মানুষটাকে দেখলে বোঝা যেত না অশোককুমার-কিশোরকুমার-ছায়াদেবী সকলেই তাঁর নিকট আত্মীয়। কিশোরকুমারের সঙ্গে ছিল তুই-তোকারি সম্পর্ক। একথা শুনেছি তাঁর মুখেই।
সম্পর্ক কেমন সহজ করে তুলতে পারতেন। তারই দু-একটা কথা বলি। এক রোববার আড্ডা মারতে মারতে বেলা বারোটা বেজে গেল। অনিলদাদের দলটা বসুশ্রী ত্যাগ করছেন। আমরা তখনও বসে। তিনি চেঁচিয়ে বললেন, ‘আরে, তোমরা বাড়ি যাও। এবার তো ভাত বন্ধ হয়ে যাবে।’
আমরা ‘যাচ্ছি’ বলতেই তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ও তোমার তো আবার ঘরবাড়ি নেই। আরে, মেসের ভাত ঠান্ডা হয়ে যাবে। ওঠো এবার।’
কথাগুলো ছুড়ে দিলেন বড়দাদার মতো। তারপর হাঁটা দিলেন।
এভাবেই চলছিল। কিন্তু, বসুশ্রীর কফি হাউসে যাওয়া কমে গেল। রবিবারগুলো এদিক-ওদিক বেরিয়ে পড়তাম। অনিলদাও বোধ হয় ছবির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এ ছাড়া, শিল্পী সংসদের কাজও ছিল। উত্তমকুমারের পর তিনি সভাপতি হয়েছিলেন। দু-পক্ষের নিয়মিত অনুপস্থিতির ফলে একটা ব্যবধান তৈরি হল। কিন্তু, আড্ডাবাজরা তো নতুন আড্ডার ঠেক খুঁজে নেয়, কিংবা, নিজেরাই ঠেক তৈরি করে নেয়। একদিন স্টুডিয়োতে দেখা। কোনো একটা ছবির শুটিং করছিলেন। টেকনিশিয়ানস’ স্টুডিয়োতে আড্ডা মারছি কয়েক জন সহকারী পরিচালকের সঙ্গে, হঠাৎ দেখি অনিলদা ফ্লোর থেকে বের হচ্ছেন। কাঁধে সেই চামড়ার ব্যাগ। একটু এগোতেই আমি উঠে গেলাম। ডাকলাম, ‘অনিলদা।’
তিনি থমকে দাঁড়িয়ে পেছন ঘুরেই একমুখ হাসি ছড়িয়ে বললেন, ‘আরে, কী খবর? বসুশ্রীতে নিশ্চয় যাচ্ছ না।’
বললাম, ‘অনেকদিন যাওয়া হয় না।’
‘খুব ব্যস্ত? রোববার সকালে আমার বাড়ি চলে এসো। শঙ্কর ভট্টাচার্য আসে। আরও দু-একজন আসে। এখন বাড়িতেই বসি।’
‘যাব। এই রোববারে যাব।’
গেলাম। ‘দৌড়’ ছবির পরিচালক শঙ্কর ভট্টাচার্য এলেন। আরও দু-একজন এল। তারা সিনেমা নিয়ে পড়াশুনো করছিল। দুপুর বারোটা পর্যন্ত আড্ডা চলত চা সহযোগে। বিস্কুট থাকত। মাঝে মাঝে থাকত মুড়ি। অনিলদার বড়োছেলের বউ অপূর্ব মুড়ি মাখতেন। মুড়ি অনিলদার বেশ প্রিয় ছিল। এইসব সাধারণ খাবার অনেক প্রথিতযশা শিল্পীদেরই প্রিয়, যা আমার নিজের চোখে দেখা। যেমন, এক রোববারের সকালে তাপস পালের বাড়ি গিয়ে দেখি পান্তাভাত খাচ্ছে।
অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সকালে পান্তা? আরে, আরও মোটা হয়ে যাবেন যে!’
উত্তরে দাঁত বের করে বললেন, ‘কী করব। ছোটোবেলার অভ্যেস। তেল, পেঁয়াজ, লঙ্কা দিয়ে পান্তা না হলে ঠিক জমে না।’
এমন দেশি খাবার অনেকেরই প্রিয়। যেমন, অনিলদার প্রিয় মুড়ি। তা, প্রায় রোববারেই হাজির হতাম গল্ফগ্রিনে। কোনো সপ্তায় হাজিরা না-দিলে বলতেন, ‘তোমার ফাইন হবে। বড্ড ফাঁকি দিচ্ছ।’
রোববার ছাড়া অন্যদিনও গেছি বিকেল বেলায়। অনিলদাই ফোন করতেন। অফিসের ফোনে। তখন তো মোবাইল ছিল না, আর আমার নিজেরও ফোন ছিল না। যে বোর্ডিং হাউসে থাকতাম (আসলে ছিল বোর্ডিং হোটেল) সেখানেও ফোন ছিল না। দরকার হলে পাশের ওষুধের দোকানে গিয়ে একটাকা দিয়ে ফোন করতে হতো। যাঁরা ফোন করতেন, তাঁরা অফিসেই করতেন। একদিন ফোন পেয়ে সন্ধ্যায় ওঁর বাড়ি গিয়ে বুঝেছি, কোনো কাজ না-থাকায় তিনি গল্প করার কাউকে খুঁজে পাচ্ছেন না। অতএব, এই উড়নচণ্ডীকেই ডাকো। একটা কথা বলে নিই, আড্ডার সঙ্গী হিসেবে একটা শর্ত ছিল, সেসব কোথাও লিখতে পারব না। তাঁর সাক্ষাৎকার নেব ঠিক করেছিলাম। বললেন, ‘রোজই তো সাক্ষাৎ হচ্ছে। আবার সাক্ষাৎকার কীসের?’ কী আর করা যাবে। আমাদের অন্য এক সাংবাদিককে দিয়ে সেই সাক্ষাৎকার নেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। তবে, আমাকে সামনে থাকতে হয়েছিল। আর ছিলেন আলোকচিত্রী অর্ধেন্দু রায়। ‘ইত্যাদি প্রকাশনী’র চিফ আর্টিস্ট ছিলেন। আবার, তরুণ মজুমদারের সহকারীর কাজও করতেন।
এভাবেই একদিন জেনে গেছিলাম তাঁর ছবি আঁকার কথা। সেবার তিনি বেশ কিছুদিন শহরে অনুপস্থিত। ঘাটশিলায় গেছেন। ফিরে এসে ফোন।
পরের রোববার গেলাম। চায়ের সঙ্গে পেঁড়া পেলাম। বললেন, ‘দেওঘর থেকে নিয়ে এসেছি।’
সেবার ‘বিভূতিভূষণ স্মৃতিরক্ষা কমিটি’র কাজ সেরে দেওঘর চলে গিয়েছিলেন। সেসব গল্প বলছিলেন, আর বুকের লোমে হাত বুলোচ্ছিলেন। হ্যাঁ, যখন আমি বা শঙ্করদা থাকতাম, গরমের দিনে লুঙ্গি আর উদোম দেহ নিয়েই আড্ডায় হাজির হতেন। বাইরের কেউ হলে গায়ে একটা হাফহাতা শার্ট গলিয়ে নিতেন। বাড়ির চিলতে বারান্দায় একটা ছোট্ট চৌকি, ছোটো টেবিল আর একটা কাঠের চেয়ার ছিল। আমি চেয়ারে বসতাম, তিনি চৌকিতে। বাড়তি কেউ হলে দু-চারটে ফোল্ডিং চেয়ার ছিল। সেগুলো নিজেকেই খুলে নিতে হতো। খুব হইচই পছন্দ করতেন না। পার্টি-টার্টি নৈব নৈব চ। গান ছাড়া আর কোনো নেশা ছিল না। একসময় সিগারেট নেশার তালিকায় ছিল, সেটাও ত্যাগ করেছিলেন। একটা ছোটো গাড়ি কিনেছিলেন। সেটাও বিক্রি করেছেন। চড়তেন ভাড়ার ট্যাক্সি, কিংবা, অটো। বলতেন, ‘আমি তো অত বড়ো আর্টিস্ট নই যে, গাড়ি চড়ব।’
............................................
উড়নচণ্ডীর পাঁচালি
সমরেন্দ্র মণ্ডল
প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল
মুদ্রিত মূল্য : ৩০০ টাকা
...........................................
সুপ্রকাশ প্রকাশিতব্য।
Comments
Post a Comment