উড়নচণ্ডীর পাঁচালি।। সমরেন্দ্র মণ্ডল।। সুপ্রকাশ
সত্যদার কথা বলেছি। সত্যদা—মানে, সত্য মজুমদার। পেশায় প্রযুক্তিবিদ, নেশায় বেহালাবাদক। বেহালা ছিল তাঁর আনন্দ, তাঁর আবেগ। সুরের সাধনায় তিনি নির্জন হয়ে যেতেন নিজের ভেতর। বোধ হয় তাঁর কখনো মন খারাপ করত না। কখনো মন এপাশ-ওপাশ করলেই বেহালায় ছড় টেনে সুরের নদীতে সাঁতার কাটতেন। ডুবসাঁতার। স্নাত হলে কিছুক্ষণ গম্ভীর দৃষ্টির আঁচল ছড়িয়ে দিতেন নীলিমে। তারপর মৃদু হেসে বলতেন, বলো।
বলার কিছু থাকে কি? শুধু তাঁর সঙ্গে স্নাত হওয়া ছাড়া। সুরের এই ঝরনাতলায় স্নান ছাড়া আর কী-ই-বা হতে পারে! সুরের মতোই তাঁর গভীর দু-চোখে ছিল আলোকবর্ণ। মাঝে মাঝে মনে হত, সারাদিন লোহালক্কড়ের সঙ্গে সহবাস করেও একটা সুরেলা মন কীভাবে পুষে রাখা যায় হৃদয় কোটরে! পরে বুঝেছি, সুর ও সংগীত পারে মানুষকে এভাবে গড়ে তুলতে।
কোন ছোট্টবেলা থেকে দেখেছি তাঁকে। যখন আমরা পুব-পাকিস্তানের দর্শনায় ছিলাম, বাবা দর্শনার কেন অ্যান্ড কোম্পানির চিনির কলে ছিলেন, সেখানেও ছিলেন তিনি। যখন আমরা চলে এলাম এপারের পলাশিতে, তিনিও এলেন। রামনগর কেরু অ্যান্ড সুগার কোম্পানি। সত্তর দশক পর্যন্ত রমরম করে চলত। পলাশির চিনি বিদেশে রপ্তানি হত। বাংলার বাজারে আসত। সত্তরের দশকেই মূলত শ্রমিক অসন্তোষ, একইসঙ্গে আখচাষিদের উৎপাদনে অনীহা, এই কারখানাকে দুর্বল করে দিল। এখন কারখানা নেই হয়ে গেছে। কত মানুষ কাজ করতেন সেখানে! কত দপ্তর! কত আবাসন! সবমিলিয়ে যেন একটা উপনগরী। কোম্পানির নিজস্ব হাসপাতাল, সমবায়িকা। গ্রামের মানুষের সহযোগিতায় গড়ে উঠেছে একটি বিদ্যালয়। এই উপনগরীর গায়ে গা লাগিয়ে দুটো গ্রাম-- তেজনগর আর পলাশি। চিনি কারখানার এই উপনগরীকে বলা হল মিল নগরী বা মিল কলোনি।
পলাশিতে এসেও সংগীত সাধনা অব্যাহত ছিল সত্যদার। এই মিল কলোনির পরিধির মধ্যেই ছিল একটা বড়ো পুকুর। লোকে বলত কালীন্দ, তার পাড়ে ইংরেজ বিজয়ের স্মারক, আর সরকারি ডাকবাংলো। এই পুকুরের দু-প্রান্তে দুটি ঝুরিনামা শতাব্দীপ্রাচীন বটগাছ। একটা মনুমেন্টের পাশে, অন্যটা মিল কোয়ার্টারের গায়ে। দুটো বটগাছই ছিল বালক-বালিকাদের খেলার জায়গা। বটের ঝুরি ধরে দোল খাওয়া। দোল খেতে খেতে কতবার যে ঝুরি ছিঁড়ে ধপাস, তার ইয়ত্তা নেই। তা, সেই বটতলায় ছিল কালীর স্থান। সেখানে ঘটা করে কালীপূজা হত। আর, কালীপুজো উপলক্ষে হত বিচিত্রানুষ্ঠান, নাটক। দু-দিন ধরে চলত। সেই নাটকের নেপথ্যে শোনা যেত তাঁর বেহালা। আবার মিল আবাসনের অন্য একটাদিকে এক অশ্বত্থ গাছের নীচে যখন অষ্টপ্রহর নাম সংকীর্তন হত, সেখানেও বালকদের তালিম দিয়ে গান গাওয়াতেন। এভাবেই তিনি শুধু মিল কলোনি নয়, আশেপাশের গ্রামেরও শ্রদ্ধেয় প্রিয়জন হয়ে উঠেছিলেন। সেই একই ধারা বজায় ছিল বীরভূমের আমোদপুরে এসেও। আমৃত্যু। সুরের সঙ্গে বসবাস আর অমায়িক ব্যবহার তাঁকে সম্মাননীয় করে তুলেছিল।
সত্যদার মতোই আরেক সাধকের সন্ধান মিলেছিল পলাশিতেই। সুগার মিলেই কাজ করতেন মান্নাবাবু। দীর্ঘ বছরের অচর্চায় নামটা হারিয়ে গেছে। শুধু পদবিটা জেগে আছে শুশুকের মতো। ছড়ানো-ছিটোনো মিল কলোনির পুবপ্রান্তে হাসপাতাল। তার সামনে একটা বিস্তৃত মাঠ। মাঠের একপাশ থেকে শুরু হয়েছে শ্রমিক আবাসন। অন্যপাশে বিস্তৃত আমবাগান, যা তেজনগর গ্রামের সীমানা। এই মাঠের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেয়ে সাদা সিঁথি পথ। গ্রীষ্মের দুপুরে মনে হয় রমণক্লান্ত বিধবার মতো নেতিয়ে আছে। সেই পথের একধারে, আমবাগানের কোল ঘেঁষে একাকী দাঁড়িয়ে আছে পাঁচিল ঘেরা একটা বাড়ি। তার হাত চারেক দূরে বিশালকায় তেঁতুলগাছ, অন্যদিকে কয়েক পা এগিয়ে বেলগাছ। এই একাকী নির্জন আবাসে থাকতেন মান্নাবাবু। বলতাম মান্নাকাকু। চাকরি করতেন কোম্পানির অফিসঘরে। চলতি কথায় ঘড়িঘর। বাকি সময় নানা কাজ তাঁর। স্বপাকে আহার। সংসারী হয়েও সংসারবিহীন তাঁর যাপন। অন্য কোনো জেলায় থাকতেন তাঁর পরিবার। পলাশিতে তিনি ধ্যানস্থ ঋষি। ছোটোদের কাছে আকর্ষণ ছিল তাঁর গবেষণাগার। সদর দরজা, তিনি থাকাকালীন অবস্থায় হাট করে খোলা। প্রবেশ, প্রস্থান অবাধ। কোনোদিন বিরক্ত হতে দেখিনি তাঁকে। নিজের কাজ করতে করতেই উত্তর দিতেন নানা প্রশ্নের। সহাস্যে। যেন তিনি মজা পেতেন।
আমরা যাওয়া-আসার পথে কখনো-সখনো ঢুকে যেতাম তাঁর ঘরে। লুঙ্গি পরে খালি গায়ে তিনি তখন কোনো রেডিয়ো নিয়ে নিরীক্ষা করছেন। ঘরে একটা চৌকির ওপর নানা আকার-প্রকারের রেডিয়ো। কেউ কেউ হয়তো সারাতে দিয়েছেন। তখন ভাল্ব রেডিয়োর যুগ। একদিন দেখি একটা বড়ো রেডিয়োর গায়ে একটা কালো গোলাকৃতি সুইচ লাগাচ্ছেন। বাড়িতে আলো জ্বালানো, পাখা চালানোর জন্য ওরকম কালো-সাদা সুইচ ব্যবহার করা হত। সেই সুইচ লাগিয়ে দিলেন রেডিয়োর গায়ে। তারপর একটা বড়ো তার ঘরে বাতি জ্বালানোর সুইচ কেটে প্লাগ লাগানোর যে সকেট থাকে তাতে গুঁজে দিলেন। বেশ চলল-- আকাশবাণী কলকাতা। বার দুই সুইচ অফ-অন করে দেখে নিলেন ঠিকঠাক শব্দ বেরোচ্ছে কি না।
কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কী করলেন?
-ডাইরেক্ট করে দিলাম।
মিল কলোনির কালো রেডিয়ো খারাপ হলেই দিয়ে আসত মান্নাবাবুকে। তিনি হাসিমুখে সারিয়ে দিতেন। কোনো পারিশ্রমিক নিতেন না। এটা ছিল তাঁর প্যাশন। শুধু রেডিয়ো নয়, পাশের ঘর যেটা ছিল শোবার ঘর, একটা চৌকির ওপর সামান্য বিছানা পাতা, আর একটা কাঠের হাতলঅলা চেয়ার, সে-ঘরটা ছিল অদ্ভুত। ঘরের দেয়ালে ঝুলছে তারসানাই, বেহালা, চৌকির এককোণে দাঁড়িয়ে আছে তানপুরা। একধারে হারমোনিয়াম বসে আছে আলগোছে। একমাত্র কাঠের টেবিলের ওপর তবলা। একটা কাঠের বেঞ্চিতে বাক্স-প্যাঁটরার ওপর শুয়ে থাকত সেতার। অনেকটা বয়স পেরিয়ে এসে সংগীতসাধক ভি. বালসারার ঘরে এরকম দেখেছিলাম। তবে, সেটা ছিল তাঁর মিউজিক রুম। গণসংগীত শিল্পী অজিত পাণ্ডের বাড়িতেও দেওয়ালে বাদুড়ের মতো ঝুলত নানা বাজনা। একটা রাশিয়ান বাজনাও দেখেছিলাম। এখন দেখতে দেখতে সেই হাফপ্যান্ট বয়সে দেখা মান্নাবাবুর কথা মনে পড়ল। একজন নির্জনপ্রবাসী সুরসাধক।
মান্নাবাবুর বাড়িতে মাঝে মাঝে বসত গানের আসর। বেশ রাতে। এলাকার সংগীতসাধকরা আসতেন। চলত শাস্ত্রীয় সুরের চর্চা। তিনি নিজেও কণ্ঠচর্চা করতেন। অনেকরকম বাজনা ছিল তাঁর অধিগত। পাড়ার দু-একটি মেয়ে রোববার সকালে তাঁর কাছে গান শিখত। শাস্ত্রীয় সংগীতের পাশাপাশি রবীন্দ্রসংগীতেও তালিম দিতেন। এই সুরের মায়াজালে জড়িয়ে পড়ল উড়নচণ্ডীও। কী কারণে জানি না, তারসানাইয়ের দিকেই তার মন গেল। মান্নাকাকুর তত্ত্বাবধানে চলল বছরখানেকের চর্চা। তারপর পড়াশুনোর স্বার্থে পলাশি ত্যাগ করার পর সে-বাসনায় ছাই পড়ল। অন্য আকর্ষণে পলাশি সরতে লাগল। ক্রমশ ধূসর হয়ে গেলেন মান্নাকাকু।
............................................
উড়নচণ্ডীর পাঁচালি
সমরেন্দ্র মণ্ডল
প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল
মুদ্রিত মূল্য : ৩০০ টাকা
...........................................
সুপ্রকাশ প্রকাশিতব্য।
Comments
Post a Comment