টুক্কা।। কৌশিক ঘোষ।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।


সুপ্রকাশ প্রকাশিত কৌশিক ঘোষের বই 'টুক্কা’ পড়ে মতামত জানিয়েছেন কৌশিক বাজারী। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
...........................................................................
সেইসব দিনের কথা,  যা আবার একদিন ফিরে আসবে বলে আমাদের মতো মানুষ অপেক্ষায় বসে থাকে। আমাদের মতো, মানে আমরা যারা পঞ্চাশ পেরোচ্ছি। সেই অতি ধীর সকাল, শান্ত দুপুর, আর হলুদ বিকালের দিন। যখন কাচের গুলি-মার্বেল পকেটে  নিয়ে কেউ রাজা কেউ ফকির। সেই পুচিল, সেই প্রিয় টল মার্বেল যা দিয়ে টুক্কা মারা হবে। সেই জলসার রাত, যখন রফি আর লতাকন্ঠী দুজনেই পুরুষ মানুষ,  আর আমরা হতবাক হয়ে দেখতাম একটা গাল বসে যাওয়া খোঁচা দাড়ির লোক কোঁচকানো  পাঞ্জাবী গায়ে মাইক হাতে দুলে দুলে গাইছে— সিসা হো ইয়া দিল টুট যাতা হ্যায়… একদম হুবহু লতা! আরেকজন লম্বা মতো ফর্সা লোক গাইছে— আ যা তুঝকো পুকারে মেরে গীত… দর্শক হৈহৈ করে উঠছে পিছন থেকে… আর?  আর ধীরে ধীরে দিন বদলে যাচ্ছে, গল্পের চরিত্র (আসলে গল্প নয়) নিমাই পাত্র হেরে যাচ্ছে। সাবোতাজ হচ্ছে দলের মধ্যেই। ৮৯ এ বার্লিন প্রাচীর ভেঙে গেল, সঙ্গে সঙ্গে সোভিয়েতের পতন আর পরের বছরেই গ্যাট চুক্তি। যেন সাজানো ছিল সমস্তই। যেন উদারতার দরজা খুলে যাচ্ছে বিশ্বে। এসব গল্পে নেই। গল্পে শুধু নিমাই পাত্র হেরে যাচ্ছে। কিশোর-কণ্ঠী তরুণ গায়ক ন্যাড়ার গানের দল আর প্রেম হেরে যাচ্ছে। ন্যাড়া হেরে যাচ্ছে। এইসব যখন ঘটছে তখন একরকম মফস্বল ছিল দেশে। তার একটা চরিত্র ছিল। তখন সমস্ত চরিত্র ভেঙে সব একাকার হয়ে যায়নি। সেরকম এক মফস্বল ঘিরে জমে উঠছে বইয়ের বেশির ভাগ গল্প।  কলকাতাও আছে। গ্রাম থেকে শহরে কেয়ারটেকারের চাকরি নিয়ে যেতে হয় যেহেতু রাধু খাঁড়াকে, তাই শহরও চলে আসে গল্পে। কিন্তু মূলত মফস্বল,  মূলত মেদনিপুর শহর আর তার আশপাশ ঘুরেফিরে আসে। আর একটা ছোট শহরের চরিত্র, তার মানুষ,  রঙ ঢঙ নিয়ে জ্যান্ত হয়ে উঠতে থাকে প্রতিটি গল্পের ভিতর। জ্যান্ত হয়ে ওঠে একটা সময়। যে সময় আর ফিরে আসেনা, যার ফিরে আসার জন্য আমরা কেউ কেউ অপেক্ষায় থাকি আজীবন…আর কেউ কেউ সাদা কাগজের উপর জ্যান্ত করে তোলে না-ফেরা সেই সময়কে। সেই সময়, যখন দশখানা কাগজ পকেটে নিয়ে নিজ পরিচয় বইতে হত না আমাদের। যখন ৯০ জন মানুষের ব্যাংক একাউন্ট রাখার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। অভাব ছিল আত্মীয়ের মতো, এসো জন বস জন। তবু যৌথতা ভেঙে পড়েনি বটতলায়। রাত বারোটায় আড্ডা ফুরিয়ে গেলে মনখারাপ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ত লোকে। প্রেম আর প্রেম ভেঙে যাওয়ার গল্পে উত্তাল হত ঘাটের জল।  তখম মনে হয়, এ তো আমারই লেখা গল্প সব! আমারই আত্মজীবনীর অংশ এইসব…

কৌশিক ঘোষের গল্প গ্রন্থ ‘'টুক্কা’’ পড়তে পড়তে এইসব মনে হল। 

কৌশিক ঘোষের টীকা : টুক্কা– শ্রেষ্ট ও শৈল্পিক শটকে টুক্কা বলা হয়। জটিল গুলির পরিস্থিতিতে যে খেলোয়াড় অভাবনীয় ও শিল্পসম্মত শট দিয়ে জিততে পারে সেই হল টুক্কা ওস্তাদ। 
........................................................
টুক্কা
কৌশিক ঘোষ
প্রকাশক : সুপ্রকাশ
মুদ্রিত মূল্য : ২৯০ টাকা




Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম।। অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। সুপ্রকাশ।।

চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে।। অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।