উড়নচণ্ডীর পাঁচালি।। সমরেন্দ্র মণ্ডল।। সুপ্রকাশ
কাজ করতাম ‘নবম দশম’ পত্রিকায়। কিন্তু, সিনেমাপাড়ার খবর লিখতাম অন্য কাগজে বেনামে। মাঝেমধ্যে ‘পরিবর্তন’-এও লিখতাম। তা ছাড়া, সিনেমাপাড়ায় যাতায়াত ছিল অনেকদিন ধরেই। ফলে, একটা টান ছিলই। অফিস ছুটির পর প্রায়ই চলে যেতাম সিনেমাপাড়ায়। কোনোদিন সমীরণ থাকত, নাহলে আমি আর অরুণদা। কখনো একাই চলে যেতাম। আর, স্টুডিয়োতে ঢোকা এত কড়াকড়ি ছিল না। ইচ্ছেমতো যাতায়াত করা যেত। অনেকের সঙ্গেই চেনা-জানা হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুত্ব হয়েছিল কারো কারো সঙ্গে। তাঁরা ছিলেন সিনেমার নেপথ্যের কারিগর। দু-চারজন পরিচালক আর শিল্পীর সঙ্গেও বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কৃষ্ণনগর থেকে অমল শূরের সঙ্গে আলাপ। পরে ঘনিষ্ঠতা। অমলদা যখন ‘রসময়ীর রসিকতা’ করেছিলেন, তখন দু-চারদিন শুটিং-এও ছিলাম। সম্পাদনার কাজ যখন চলছিল, তখন সেখানে কাজ দেখার জন্য থাকতে দিয়েছিলেন। অনেক কারিগরি বিষয় শিখেছিলাম তাঁর কাছ থেকে। অমলদা বলতেন, সিনেমার খুঁটিনাটি না-জানলে ভালো সমালোচক হওয়া যায় না।
তা, সেই সান পাবলিসিটির দৌলতে একদিন রায়বাবুর বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। সত্যজিৎ পুত্র সন্দীপ রায় হাতেখড়ি দিলেন ‘ফটিকচাঁদ’ ছবি করে। ছেলের পরিচালনায় প্রথম ছবি। বাবা সত্যজিৎ পেছন থেকে মদত দিয়ে যাচ্ছেন। চিত্রনাট্য তিনি লিখেছিলেন। গল্পও তাঁর। সংগীত পরিচালনাও তিনি করছেন। সত্যজিৎ টিম কাজ করছে ‘ফটিকচাঁদ’ ছবিতে। প্রচার পরিকল্পনাও করেছিলেন রায়বাবু নিজে। একই সময়ে সত্যজিৎ রায় ফরাসি টিভির জন্য ‘পিকু’ নামে ছোটো ছবি করেছিলেন। প্রাপ্তমনস্ক ছবি। ছেলের প্রথম ছবি, খুব বড়ো ছবি ছিল না। সত্যজিৎ রায় বোধ হয় ঠিক ভরসা করতে পারছিলেন না। তিনি স্থির করলেন ‘ফটিকচাঁদ’-এর সঙ্গে ‘পিকু’ মুক্তি পাবে। পোস্টারের নকশাও তিনি করছেন।
এসব খবর জানা গেল তাঁর বাড়িতে গিয়েই। একদিন দুপুরে শিল্প বিভাগে বসে কাজ করছি। অরুণদা খুব নীচুস্বরে বলল, ‘সন্ধেবেলায় সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি যাব। তৈরি থাকিস।’
ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। কতদিনের বাসনা তাঁর সামনে বসার।
আমাদের অফিস ছুটির একটু আগেই সমীরণ এল। অফিস ছুটির একটা নির্দিষ্ট সময় ছিল ঠিকই। কিন্তু, পত্রিকার অফিস। সম্পাদনার কাজ থাকলে দেরি তো হতোই। আবার, বাইরের কোনো কাজের নির্দেশ থাকলে, যেতে হতো। সেটা তো কাজের মধ্যেই পড়ত। কাগজের অফিসে সবই তো নিয়মমতো চলে না। তবুও ছুটির একটা নির্দিষ্ট সময় ছিল। সমীরণ আসতেই তাকে বললাম রায়বাবুর বাড়িতে যাওয়ার কথা। সে তো একপায়ে খাড়া। সে বলল, ‘বাড়ির ভেতরটা কেমন একটু দেখব।’
কাজের তল্পিতল্পা গুটিয়ে বের হলাম। অরুণদার সঙ্গে সোজা বিশপ লেফ্রয় রোডে। সিঁড়ি দিয়ে উঠছি। আর বুকের মধ্যে হাপর টানছে। অবশেষে বন্ধ দরজার সামনে আমরা। অরুণদা ঘণ্টি বাজালেন। দরজা খুললেন সন্দীপ। ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ‘অরুণদা এসেছেন।’
অবশ্য, ততক্ষণে তিনি দরজা থেকে সরে গেছেন। ভেতর থেকে মেঘমন্দ্র স্বর ভেসে এল, ‘ভেতরে এসো।’
অরুণদার পেছন পেছন আমরা। বিশাল ঘর। ভেতরের ঘরে যাওয়ার দরজার কাছাকাছি একটা ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে পেটের ওপর বেশ বড়ো একটা ক্লিপবোর্ডে আঁকিবুকি করছেন। বললেন, ‘বোসো।’
নিজের মনে কাজ করতে করতেই বললেন।
অরুণদা বলল, ‘বোস।’
ঘরে কোনো আসবাবপত্র নেই। একদিকে দুটো সোফা আছে। প্রশস্ত মেঝেয় কার্পেট পাতা। ছড়িয়ে আছে বিদেশি রেকর্ড। নানা বই। অগোছালো ঘর। এমন ঘর তো শিল্পীকেই মানায়। বসলাম কার্পেটের ওপর। অরুণদাও বসল। সে তখন ঝোলা থেকে কাজের কিছু সরঞ্জাম বের করেছে। আমার ওদিকে নজর নেই। রেকর্ডগুলো দেখছি, পড়ার চেষ্টা করছি কার সংগীত। বুঝতে পারছি ফটিকচাঁদ-এর সংগীত রচনার জন্য তিনি এইসব বিদেশি রেকর্ড বের করেছেন। এমন সময় ঘরের মধ্যে মেঘ ডাকল, ‘অরুণ।’
অরুণদা উঠে তাঁর সামনে গেল। কিছু ডিজাইন বুঝিয়ে দিলেন। অরুণদা আমাদের দু-জনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। আমি ‘কিশোর মন’ পত্রিকায় আছি জেনে তাকালেন। বললেন, ‘অদ্রীশ...।’
ছোটো জবাব, ‘হ্যাঁ।’
অদ্রীশ মানে অদ্রীশ বর্ধন। রহস্য-রোমাঞ্চ-গোয়েন্দা উপন্যাস লেখক। সত্যজিৎ রায়ের ঘনিষ্ঠ। আকাশবাণী কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে প্রেমেন্দ্র মিত্র, সত্যজিৎ রায় আর অদ্রীশ বর্ধন তিনজনে একসঙ্গে একটা গল্প লিখেছিলেন ‘সবুজ মানুষ’ নামে।
তিনি আবার মগ্ন হলেন কাজে।
অরুণদা ছবি আঁকা ড্রয়িং পেপার নিয়ে এল। ওপরে ছবি আঁকা। সিনেমার নামও দেওয়া আছে। অরুণদা একটা ফটোস্ট্রিপ বের করল। বলল, ‘এখানে সাঁটিয়ে দে তো।’
দিলাম। সেটা নিয়ে অরুণদা আবার রায়বাবুর কাছে গেল। তিনি বেশ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে স্ট্রিপটা তুলে ফেললেন। একটু বাঁকা করে বসিয়ে দিলেন। দেখলাম, একটা সুন্দর ডাইমেনশন তৈরি হল।
ততক্ষণে সন্দীপ রায় একটা বড়ো কাচের প্লেটে তিনরকমের সন্দেশ আর জল রেখে গেছেন। সন্দেশ দেখেই লীলা মজুমদারের পারলৌকিক কর্মের দিনটার কথা মনে পড়ল। সমীরণকে বললাম, ‘সন্দেশ।’
সমীরণ আলতো করে বলল, ‘ব্রাহ্ম।’
অরুণদা বসে বসে পোস্টার ডিজাইন করছে। কিছুটা করে, আবার উঠে যায়। তিনি কিছু পরামর্শ দেন। এভাবে কাজ করতে ঘণ্টা দুয়েক পার হল। তিনি বললেন, ‘মাদ্রাজে কে যাবে?’
অরুণদা আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘এ যাবে।’
তিনি আমার হাতে ছোটো খাতার মাপে একটা নকশা দিলেন। একটা খামে ভরে। বললেন, ‘এটা দিয়ে দেবে। আমার নাম করবে।’ তিনি প্রেসের ঠিকানাও লিখে দিলেন।
আমি সাহস করে বললাম, ‘এত ছোটো মাপ থেকে বড়ো পোস্টার করতে পারবে?’
তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘আমি এভাবেই করে দিই। ওরা ডায়াগনালি বড়ো করে নেবে। ওরা জানে।’
‘ফটিকচাঁদ’ ছবির কিছু প্রচারের দায়িত্ব সান পাবলিসিটি পেয়েছিল। দু-একদিন পর মাদ্রাজ, মানে, চেন্নাই যাওয়া স্থির হল। কারণ, আমাকে অফিস থেকে ছুটি নিতে হবে। টিকিট কাটতে হবে। ছবি মুক্তি পেতে তখনও মাস দেড়েক বাকি। ততদিন প্রচারের কাজ চলবে। রায়বাবু সেসব নিয়ে আলোচনায় বসবেন। সম্ভবত উত্তর কলকাতার ‘উত্তরা’ প্রেক্ষাগৃহে ছবি মুক্তি পেয়েছিল। হল সাজানোর কোনো দায়িত্ব ছিল না। তিনি বললেন, ‘ওসব ওরা করে নেবে।’ মানে, ছবির পরিবেশক সংস্থা।
চেন্নাই থেকে ঘুরে আসার দিনসাতেক পর জানা গেল, পোস্টার চলে এসেছে। চেন্নাইয়ের ‘মাদ্রাজ প্রেস’ পাঠিয়ে দিয়েছে। রায়বাবুর ডাকে আবার যাওয়া হল বিশপ লেফ্রয় রোডে। সেদিনের আলোচনার সময় সন্দীপ রায়কে ডেকে নিলেন। ছবি শুরুর আগে সন্দীপ রায় নিজে থাকবেন অতিথি বরণের জন্য। সান পাবলিসিটির তরফে আমি আর সমীরণ থাকব। অরুণদা বলল, ‘এরা দু-জন একটু আগে হলে চলে যাবে।’
সেদিন কিছু বলিনি। পরে সমীরণের সঙ্গে আলোচনা করলাম কীভাবে ডুব দেওয়া যায়। ছোটোদের ছবি ‘ফটিকচাঁদ’-এর সঙ্গে প্রাপ্তমনস্ক ছবি ‘পিকু’ জুড়ে দেওয়াটা ঠিক মন থেকে মেনে নিতে পারছিলাম না। ছেলের ছবিকে প্রোমোট করার জন্য রায়বাবুর এই কাজটাকে অনেকেই সমর্থন করেনি। একটা চাপা গুঞ্জন ছিল। কিন্তু, সত্যজিৎ রায় ছিলেন অবিচল। ছবি মুক্তির দিনদুয়েক আগে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে বাইরে চলে গেলাম। সমীরণও যায়নি। পত্রিকার কাজে বাইরে যাচ্ছি, অরুণদারও কিছু বলার ছিল না।
এর পরে সান পাবলিসিটি আর কোনো কাজ পায়নি রায়বাবুর কাছ থেকে। আমাদেরও আর যাওয়া হয়নি। উড়নচণ্ডী এই ছোট্ট স্মৃতিটুকু বুকে নিয়ে সিনেমাপাড়ায় অন্য শিল্পীদের সান্নিধ্যে চলে গেল। সেসব অবশ্য কাগজে কাজ করার সৌজন্যেই।
............................................
উড়নচণ্ডীর পাঁচালি
সমরেন্দ্র মণ্ডল
প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল
মুদ্রিত মূল্য : ৩০০ টাকা
...........................................
সুপ্রকাশ প্রকাশিতব্য। আসছে আগামী সপ্তাহে।
Comments
Post a Comment