উড়নচণ্ডীর পাঁচালি।। সমরেন্দ্র মণ্ডল।। সুপ্রকাশ

আমাদের তখন হাফপ্যান্টের বয়স। সেইসময় পুরো স্কুলজীবনটাই হাফপ্যান্টে কেটে যেত। কলেজে ঢুকলে ফুল প্যান্ট পরার অধিকার জন্মাত। তা সেই বয়সে, আমরা তখন নবম শ্রেণি। তখনই কালু চলে গেল। বীভৎসভাবে। তখনও মৃত্যু সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল না।
বাংলার নবাবি আমলের সূর্য অস্ত গেল যে পলাশির যুদ্ধে, বহু বছর পর্যন্ত তার স্মৃতি ছড়িয়ে ছিল যে গ্রামে এবং এখনও একটি স্মৃতিস্তম্ভ বিরাজ করছে, সেই বিস্তৃত পলাশির এক অংশে চিনির কারখানা। সেই কারখানার সংলগ্ন অঞ্চল জুড়ে কর্মীদের আবাসন। এসবই কারখানার মালিকের। আছে হাসপাতাল, সমবায় দোকান এবং কারখানার মালিকের পৃষ্ঠপোষকতায় একটা হাইস্কুল। সেই স্কুল অবশ্য সরকারপোষিত এবং আজও দীপ্যমান। পলাশি সুগার মিল কলোনি নামে সন্নিকটস্থ গ্রামের মানুষের কাছে পরিচিত হলেও, আসলে সে ছিল এক উপনগরী। সেই উপনগরীর একদিকে সমবায়িকার পাশেই তাদের দুই কুঠুরি আবাসন। চলতি কথায় কোয়ার্টার। পড়ত পলাশি হাইস্কুলে। আমাদের সহপাঠী। একসঙ্গে খেলাধুলো, একসঙ্গে ইস্কুল। রবীন্দ্রজয়ন্তী কি স্বাধীনতা দিবস— সবখানেই কালু আছে সঙ্গে। তা, সেই কালুও চলে গেল।
সে গত শতাব্দীর ছয়ের দশকের শেষদিকের ঘটনা। বাংলা জুড়ে খাদ্য আন্দোলন হয়ে গেছে। মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনের কাঁচকলা খাওয়ার পরামর্শের ব্যঙ্গচিত্র ছড়িয়ে পড়েছে, বাম আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। তার আঁচ পড়েছে আমাদের উপনগরীর আশেপাশে। না, তার সঙ্গে কালুর মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক ছিল না। তার মৃত্যু ছিল আকস্মিক।
খবরটা এল ইস্কুলের শেষ পিরিয়ডে। যতদূর মনে পড়ছে কেউ একজন আকাশবাণী হয়ে হেডস্যারের কানে খবরটা পৌঁছে দিয়েছে। কালুর সাংঘাতিক দুর্ঘটনা হয়েছে, তাকে কালিগঞ্জে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং সে আর নেই। স্কুলের শেষ ঘণ্টা বেজে গেল। আমরা ছুটলাম কালুদের আবাসনে। বেশ ভিড়। আছে বড়োরাও, ছোটো-বড়ো মেয়েরাও। ছোটাছুটি করছে কৌতূহল— কী করে হলো? কী করে হলো? মুখে মুখে একটা কাহিনিও তৈরি হয়ে গেল, যা এই উড়নচণ্ডীর জীবনসন্ধ্যাতেও জ্বলজ্বল করছে।
কালু সেদিন ইস্কুলে যায়নি। ক্লাসে ‘প্রেজেন্ট, স্যার’ বলেনি। কেন যায়নি কেউ জানে না। হতে পারে তার মন খারাপ হয়েছিল। তার তো মাঝেমধ্যেই মন খারাপ হত। যেমন আমাদেরও হত। তখন তো আমাদের মন খারাপের বয়স। অথবা, তার শরীর খারাপও হতে পারে। সে দাঁড়িয়ে ছিল ওদের কোয়ার্টারের পাশে সমবায়িকার কাছটিতে। কোম্পানির বেডফোর্ট লরি এসেছিল মাল খালাস করতে। খালি লরি নিয়ে ড্রাইভার কাকু একটু এগোতেই মানে লরির চাকা গড়াতেই, রৈ রৈ চিৎকার ভেসে এল। লরি থেকে নেমে এসে ড্রাইভার কাকু দেখেন, কালুর মাথা চাকার নীচে। কী করে কী হল? ওই লরি নিয়ে দু-চারজন ছুটল কালিগঞ্জ হাসপাতালে। ছোটো হাসপাতাল। সেখানে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করে। ড্রাইভার কাকু সোজা থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন।
এসব কথা ছুটে বেড়াল পলাশির প্রান্তরে। চরাচর জুড়ে ছড়িয়ে আছে বিষণ্ণতা। কিশোর-কিশোরীদের মন ভার। এখানে-ওখানে জটলা। নীচুস্বরে নানা কথা।
পরদিন স্কুল ছুটি হয়ে গেল ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ গাওয়ার পর। হেডমাস্টারমশাই দু-চার কথা বলার পর সকলে বই বগলে বাড়ির পথে। না, সকলেই গেল না। অনেকেই গেল। বাকিরা হেডমাস্টারমশাইয়ের পেছন পেছন, অন্যান্য মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে হাসপাতালের সামনে। ওখানে কালুকে আনা হবে শেষ দেখার জন্য। এলাকার মানুষেরাও আছেন। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর কোম্পানির একটা লরিতে শুয়ে কালু এল। তার মাথা থেকে ঘাড় পর্যন্ত ব্যান্ডেজ বাঁধা। শুধু চোখ, নাক আর ঠোঁটের কিছুটা দেখা যায়। লরির পেছনের ডালা খুলে একটা কাঠের মই লাগানো হল। এই মইয়ে চড়ে একে একে একপলকের দেখে নেওয়া। আহা, কালু ঘুমোচ্ছে। কী প্রশান্তি! মনে হয়, এইমাত্র ঘুম থেকে জেগে, উঠে বসে বলবে, চল ঘুরে আসি।
সেই শেষ দেখা কালুকে। ওর স্কুলের খাতায় লেখা কাঁলাচাদ নামটা ক্রমশ ধূসর হয়ে গেল। কিন্তু মিল কলোনির, আমাদের বুকে সে থেকে গেল। অনেকদিন। ওদের কোয়ার্টারের সামনে গেলেই মনে হতো, কালু দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে এসে বলবে, কোথায় যাচ্ছিস? মনুমেন্টের দিকে যাবি?
.........................................
উড়নচণ্ডীর পাঁচালি
সমরেন্দ্র মণ্ডল

প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল
মুদ্রিত মূল্য : ৩০০ টাকা
...........................................
সুপ্রকাশ প্রকাশিতব্য।


Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম।। অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। সুপ্রকাশ।।

চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে।। অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।