উড়নচণ্ডীর পাঁচালি।। সমরেন্দ্র মণ্ডল।। সুপ্রকাশ

হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলেছি। পাত্রবাজারের মধ্যে দিয়ে। তখনই দেখি মজনু এগিয়ে  আসছেন তাঁর স্বভাব-ভঙ্গিমায়। ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত, চোখে চশমা, বাবরি চুল, কপালের ওপরের চুল সরে গিয়েছে অনেকখানি। কাঁধে কাপড়ের ঝোলা। হাঁটছেন, তিনি হাঁটছেন। শহরের রাজপথ মাড়িয়ে এগিয়ে চলেছেন কবি মজনু মোস্তাফা। ওই ঝোলায় হাত দিলে নিশ্চয় পাওয়া যাবে তাঁর কবিতার ডায়েরি।
মজনু নামটা ষাট, সত্তর, আশির দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত শহরকে আলোড়িত করেছিল। কবিতায় ছিল সরলতা। আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করতে ভালোবাসতেন। পেশায় ছিলেন ইংরেজির শিক্ষক। নেশায় কবি। আরেকটা নেশাও ছিল। রাত একটু বাড়লে অথবা না-বাড়লে তিনি আসবাসক্ত হতেন। তখন তিনি উদ্দাম। বয়সের শিকল খুলে ছুড়ে ফেলে দিতেন শহরের পথে। বুকের ভেতর জমে থাকা সমস্ত অভিমান ক্রন্দন হয়ে ছড়িয়ে পড়ত। বামপন্থায় ছিল বিশ্বাস, আবার বামপন্থার তীব্র সমালোচকও বটে। শহরের এক এক মানুষের কাছে তাঁর এক এক গল্প। তাঁর পৃথিবী ত্যাগের চল্লিশ বছর পরেও তিনি একইরকম সজীব শহরের বৃত্তে। একটু উসকে দিলেই শোনা যাবে তাঁর কাণ্ডকারখানা। জাত বোহেমিয়ান। আমি বলি, উড়নচণ্ডী। তিনি বলতেন, রাঁবো ছিল তার প্রিয়। রাঁবোর মতোই তিনি উদ্দাম।
ভণিতা ছেড়ে গল্পে আসি। পলিটেকনিক কলেজে প্রথম বছরের ছাত্র। কলেজ তখন বামপন্থীদের আঁতুড়ঘর। তিন-চাররকম বামপন্থী ছাত্র সংগঠন। বাম, উগ্রবাম, মধ্যবাম। তা, ওই কলেজেরই এক ছাত্র আমায় ধরলে একদিন। সেবার কলেজে নাটক হয়েছিল। তাতে একটা পার্ট পেয়েছিলাম। প্রশংসাও পেয়েছিলাম। অনেকে আমাকে সেই অভিনীত চরিত্রের নামেই ডাকত। তারও আগে নবীনবরণ অনুষ্ঠানে বলেছিলাম কবিতা। ফলে, চিনেছিল আমাকে অনেকেই। সুবীরও চিনেছিল। আমার থেকে একস্তর উঁচুতে পড়ে। লম্বা চেহারা, চোখে মোটা কাচের চশমা। একদিন কলেজে ধরল আমায়, বিকেলের দিকে কী কর?
–কেন?
–আমাদের একটা সাংস্কৃতিক গ্রুপ আছে, এসো না একদিন?
–কী হবে?
–গানের একটা দল হবে, নাটক করা হবে। কবিতা চর্চাও হবে।
একটু ভেবে উত্তর দিলাম, যাব।
কোনো এক রবিবার বিকেলে যাওয়ার কথা বলেছিল, জজ কোর্টের পেছনে একটা হলুদ রঙের বাড়ি। সামনে লোহার ঘোরানো সিঁড়ি। এই সিঁড়ি বেয়ে দোতলায়। বসে আছে জনাদশেক যুবক-যুবতী। সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল সুবীর। সুবীর বোস। বুঝলাম সে-ই নেতা। নানা কথা হচ্ছে। কিছু শুনছি, কিছু শুনছি না। কথা চলছে, এমন সময় ঝড়ের মতো ঢুকলেন ওই বাবরি চুল, চশমা চোখে মানুষটা। সুবীর বলল, এই তো, নির্মাল্যদা এসে গেছে।
মানুষটাকে দেখে মনে হল নাটকের। আবার মনে হল নেতা হতে পারেন।
তিনি কিছু শুনলেন, কিছু বললেন। এটুকু জানলাম তিনি নির্মাল্য ভট্টাচার্য। কবিতা লেখেন। অভিনয় করেন। হ্যাঁ, মনে পড়ল ‘নীচের মহল’ নাটকেই সম্ভবত তাঁর অভিনয় দেখেছিলাম। কিছুক্ষণ থাকার পর, যখন সুবীর পরিচয় করিয়ে দিল, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কবিতা লেখো?
–চেষ্টা করি। 
আলগোছে উত্তর দিলাম।
তিনি বললেন, চলো।
সভার মাঝপথেই তাঁর সঙ্গে বেরিয়ে এলাম। আমারও অস্বস্তি হচ্ছিল। শুধু কথা হচ্ছে। ফিকির খুঁজছিলাম বেরিয়ে আসার। নির্মাল্যবাবু বলতেই একপায়ে খাড়া। ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে আবার নীচে। শুরু হল হাঁটা। তিনি বললেন, এখানে আসার দরকার নেই। এরা সি পি আই করে। একসময় আমিও করতাম। এখন করি না। আমার দাদা করে। তুমি তো কবিতা লেখো। কবিতা নিয়ে আমার বাড়িতে চলে আসবে। কবিতা শুনব।
একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, চা খাও।
চা পানের পরে বলে ফেললাম, নির্মাল্যবাবু, আমি তাহলে আসি? আসলে আবাল্য মিশনারি স্কুলে পড়ার জন্য এমন সম্ভাষণে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু, তিনি আমার মুখের দিকে চেয়ে বললেন, বাবু নয়, দাদা বলবে।
তারপর আর কোনো কথা না-বলে মুখের দিকেই তাকিয়ে রইলেন। আমি কী বলব বুঝতে পারছি না। তিনি হঠাৎ ‘ঘ্যাঁচ্চো’ বলে হাঁটা দিলেন পাত্রবাজারের দিকে। আমি ভ্যাবাচ্যাকা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হাঁটা দিলাম ওই পথেই।
তার বেশ কিছুদিন পর ‘দ্বন্দ্ব’ মিনি পত্রিকার লেখা সংগ্রহ করতে যেতেই হলো তাঁর বাড়ি। সম্পাদক শতদল দত্ত বলেছিল, মজনু মোস্তাফার একটা কবিতা জোগাড় কর। কিন্তু, আমি তো মজনুকে চিনি না। কোনো কবিকেই তো চিনি না। সুধীরবাবুর কাছ থেকেই কেবলমাত্র একটা লেখা নিতে পেরেছি। মুশকিল আসান করলেন বৃন্দাবন গোস্বামী। তিনি স্বাস্থ্য দপ্তরে কাজ করতেন। স্বাস্থ্যকর্মীরা তখন বাড়ি বাড়ি যেতেন কারো কোনো বড়োরকমের অসুখবিসুখ আছে কি না জানতে। দরজায় লাল-নীল পেনসিলে পরিদর্শনের তারিখ লিখে রাখতেন। তাঁর সঙ্গে কথায় কথায় জেনেছিলাম, তিনি কবিতা লেখেন। তাঁর কাছ থেকেই হদিশ পেলাম মজনু মোস্তাফার বাড়ির। জানলাম নির্মাল্য ভট্টাচার্যই মজনু মোস্তাফা।
একদিন বুক ঠুকে চলে গেলাম। সেও এক রোববার সকাল। একপাত্র চা পেলাম। সঙ্গে চারলাইনের কবিতা। ক্রমশ বাড়ল ঘনিষ্ঠতা। তারপর রঙিন স্মৃতির কার্পেট পাতা হতে লাগল। মাঝে মাঝেই, কোনো কোনো রোববার চলে যেতাম মজনুদার বাড়ি। ওখানেই আলাপ হয়ে গেল হরিপদ দে আর শ্যামল রায়ের সঙ্গে। আগেই ‘‘বর্ণিনী’ নামে এক শারদসংখ্যায় হরিপদ দে-র গল্প ‘তিনটি হরিণ শিশু’ পড়েছিলাম। ভেতরে ভেতরে লেখকের সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছে ছিল। হয়ে গেল। শ্যামলদা তখনও বোধ হয় অধ্যাপনায় যোগ দেননি। লিখতেন কবিতা, প্রবন্ধ। মজনুদার বাড়িতে জমায়েত হতেন এঁরা। চলত কবিতা পড়া, গল্পগাছা। তবে, বেশিক্ষণ নয়। ঘণ্টাখানেক বা দেড়েক। তারপর সদলে বেরিয়ে পড়তেন ওঁরা। আমি দলছুট হয়ে বাড়ির পথে।
ক্রমশ মজনুদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ল। যেমন সকলেরই বাড়ে। ব্যাগে থাকত কবিতার ডায়েরি। দেখা হলেই কোথাও-না-কোথাও বসে কবিতা শোনাতেন। ততদিনে বেরিয়েছে তাঁর কবিতার বই ‘উনিশ যন্ত্রণা’। বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল কবিতাগুলো। অনেকেরই মুখে মুখে ঘুরত তাঁর কবিতার পঙ্‌ক্তিগুলো। মাঝেমধ্যেই চলে আসতেন কলকাতায়। কফি হাউস সেরে সটান খালাসিটোলায়। ততক্ষণে সেখানে শক্তি হাজির। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সুনীল গাঙ্গুলিও থাকতেন অনেক সময়। সেখানে চলত ছোটো-বড়ো কবিদের জলকেলি। সেইসময় প্রায়ই দেখা যেত কলকাতার রাজপথে মধ্যরাতে তিন কবি হেঁটে যাচ্ছে ‘পা টলমল পা টলমল’। মজনুও টলটলায়মান হয়ে রাত মধ্য হওয়ার আগেই ফিরে আসতেন নিজের শহরে।
রাত ঘুরে সকাল হতেই মজনু তখন কর্তব্যপরায়ণ। তাঁর দুই কন্যার পড়াশুনোর তদারকি। স্কুলে যাওয়া। ছাত্র পড়ানো। এমনকী স্কুলের পরেও বিনা বেতনে গ্রামের দু-চারজন ছাত্র পড়িয়ে বা অনুপস্থিত ছাত্রের বাড়িতে খোঁজখবর নিয়ে ফিরতেন শহরে। মাস্টারি করতেন জেলার শতাব্দীপ্রাচীন স্কুল চাপড়া কিংএডোয়ার্ড হাইস্কুলে। সেই স্কুল আজও তাঁকে স্মরণ করে। এহেন ছাত্রবৎসল, কর্তব্যপরায়ণ শিক্ষক শহরে পা রাখলেই আদ্যন্ত কবি। কখনো লেখরাজদার চায়ের দোকানে, কখনো পাত্রবাজারে ‘শোভন মুদ্রণী’তে পা রাখতেন আড্ডার মেজাজে। বেশিক্ষণ বসতেন না কোথাও। আবার বেরিয়ে পড়তেন অন্য কারো খোঁজে। সন্ধের পর ঈষৎ তরলে অভ্যস্ত ছিলেন। আর, সম্ভবত সেই তরলই তাঁকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াত। কখনো একা, একেবারে একা। কৃষ্ণনগর কলেজের সামনের হাঁ-মুখ মাঠে অন্ধকারে একা বসে থাকতেন। উপভোগ করতেন অন্ধকারের সৌন্দর্য। আবার কখনো আমাদের মতো দু-একজন উড়নচণ্ডীকে পাকড়াও করে চলে যেতেন কলেজ মাঠে, কখনো কারবালার মাঠে। বসে থাকতেন। অন্ধকারের মধ্যে ভেসে থাকা প্রকৃতির আলো গায়ে মেখে বলতেন কবিতার কথা, কবিদের কথা। বেশিরভাগই ইংরেজ কবিদের কথা বা ফরাসি কবিদের কথা। কেটে যেত অনেকটা সময়। দূরে কোথাও কুকুর ডাকলে উঠে ধুলো ঝেড়ে হাঁটা দিতেন বাড়ির পথে দ্রুতপায়ে।
............................................
উড়নচণ্ডীর পাঁচালি
সমরেন্দ্র মণ্ডল

প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল
মুদ্রিত মূল্য : ৩০০ টাকা
...........................................
সুপ্রকাশ প্রকাশিতব্য। আসছে আগামী সপ্তাহে।

Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম।। অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। সুপ্রকাশ।।

চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে।। অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।