মিহির সেনগুপ্তর ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’ পড়ে লিখেছেন শুভদীপ চক্রবর্তী

সুপ্রকাশ প্রকাশিত মিহির সেনগুপ্তর ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’-এর পাঠ-প্রতিক্রিয়া লিখেছেন শুভদীপ চক্রবর্তী। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি। 
—————————————————

সুর যেখানে ঘরে ফেরে...
---------------------------------

ভিনরাজ্যে ভাড়া বাড়ির পাশেই কোভিড হসপিটাল। ভাইরাস বায়ুবাহিত। আচমকা নিদান তাই, ছাদে ওঠাও যাবে না! খোলা জানালায় রাত-বিরেতে টর্চ। “জি বন্ধ রাখিও!” কিন্তু এভাবে বন্ধ হয়ে কতদিন? পালাতে ইচ্ছা করে যখন খুব, তখনই হাতে এল ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’। কলকাতা থেকে উপহার। আর শুরু হল অমলিন একটা ভেসে চলা।

আমার তো ঠাকুরদার দেশ ছিল নোয়াখালি। ঠাকুমার ছিল কুমিল্লা। গান্ধিজীর মিছিলে হাঁটা ঠাকুরদা বদলে ফেলল দেশ তারপর। নবদ্বীপের কাছে ভান্ডারটিকুরি। চাকরি নিয়ে বাটা সাহেবের কোম্পানিতে তারপর। অথচ দেশ বদল হয় কি সত্যিই? নতুন করে চিনে নিতে ইচ্ছা হয় না ফেলে আসা খাল, বিল, সবুজ?

অসম্ভব এক জার্নির কথা বলে যায় আমাদের ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’। খুঁজে চলা শিকড়ের টানে ফিরে যেতে যেতে কথক ভুলিয়ে দেন ভাষার দ্বন্দ্ব। বরিশালি ভাষায় আটকে গিয়ে তাই বাবার কাছে ফিরে যাই। অনেকদিন পর। সেই কোন ছোটবেলা পেরিয়ে আসবার পর আবার বই পড়ে শোনাতে শুরু করে বাবা। কথ্য ভাষার মানে বলতে বলতে পেরিয়ে যায় অনুচ্ছেদের পর অনুচ্ছেদ। একসময় পাঠে গতি এসে গেলে বুঝতে পারি, নিজেই পড়ে নেওয়া যাবে। তারপরে নিজেরও সেই জার্নির অংশীদার হয়ে পড়া অগত্যা; পৌঁছতে চাওয়া সেই আলো-হাওয়ার সিদ্ধিগঞ্জের মোকামে।

শুধু নস্ট্যালজিয়া নয়, ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’ বরং দুই বাংলার বিচ্ছেদের ইতিহাসটাকে নাড়িয়ে দিয়ে যায় অনেকখানি। সন্দেহ করতে শিখিয়ে দিয়ে যায় ক্ষমতাকে। খানসেনা হোক বা মুক্তিযোদ্ধা, আদতে যার হাতে বন্দুক, সেই যে একসময় ক্ষমতার অলিন্দে পৌঁছতে অন্যের মাথায় পা রাখবেই— সেই কথাও উঠে আসে কী চমৎকার ভাবে। না, কোনোরকম গবেষণা গ্রন্থ এটা নয়; বরং সেই কথা উঠে আসে সাধারণের কথায়, ভাষ্যে। সংলাপে।

‘জ্বলন্ত সময়ের দলিল’ জাতীয় কোনও বহু ব্যবহারে জীর্ণ শব্দ এই বইয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার না করে বলা যায় বরং, সাধারণ মননের এক লিখিত ডকুমেন্টারি। সারারাত জেগে হুল্লোড় আছে যেখানে। আছে জাতপাতের সংকীর্ণতার মাঝেও সেসবের মধ্যে অনাবিল ভাবেই মিলিয়ে দেওয়া হিউম্যান সাইকো। দুর্গাপুজোর উৎসব তো ফিকে সেই মিঞা মানুষটার জারি গান ছাড়া। অথবা জাতে মুসলিম, পদবীতে ‘ঠাকুর’ উপাধি যে মানুষটার, সে না থাকলে কীভাবেই বা হবে অত লোকের পুজোর ভোগ? ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’ শেষ করতে আমার সময় লেগে যায়, কারণ সময় লেগে যায় ভাষাটার মধ্যে ঢুকতে। একবার ঢুকে গেলে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মতো সুর আলাপ থেকপ কখন ঝালায় উঠে যে ভাসাতে থাকে উন্মনে, তার হদিশ পাওয়া যায় না।

হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বলে, সুর যেখানে ঘরে ফেরে, সেটাই হল ‘মোকাম’। এমন একটা সময়ে ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’ পাঠ শেষ হয়, বাংলাদেশে টালমাটাল করা ব্যাপারটা ঘটে গেছে। ঠাকুরদা-ঠাকুমার ‘দেশে’ই আঘাত বেশি। অথচ এই ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’ অন্যই একটা দুর্গাপুজো, জারিগান, হাসি, মজা, কান্নার আবহসঙ্গীত শুনিয়ে যায় আমাদের। ভিন রাজ্যে যে জার্নির শুরু, তার শেষ হয় আমার ছাপোষা মফস্বলের ঘরে, শারদীয়ার পরে যখন কুয়াশা কুয়াশা ভোর। একটা মনখারাপ দিয়ে যায় খুব। কুয়াশার ওপারে দেখতে পাই যেন নিজেরও ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’। যেখানে ভাঙা মন্ডপ নেই। আতঙ্ক নেই। চিৎকার নেই। বরং হাসতে হাসতে এলিয়ে পড়া আছে এ-ওর গায়ে। একে অন্যকে আগলে রাখা আছে অধিকারের আদরে। ওই তো, হিন্দুগো উৎসবে সারা রাত আসর জমাচ্ছে ছোমেদ মিঞা। এই কাঁদাচ্ছে তো, হাসাচ্ছে এই। দমে পাক দাও খলিল ঠাকুর! নিরামিষ পাঁঠার মাংসে জমে উঠুক অষ্টমীর ভোগ। জোরে নাও টানো হে নাইয়া! সিদ্ধিগঞ্জের মোকামে পৌঁছতে আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে তো...

সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম
লেখক : মিহির সেনগুপ্ত
প্রকাশক : সুপ্রকাশ 
প্রচ্ছদ : তিস্তান

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।