শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের উপন্যাস 'শেষ মৃত পাখি' পড়ে লিখেছেন সায়ন সরকার

সুপ্রকাশ প্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের উপন্যাস ' শেষ মৃত পাখি ' পড়ে লিখেছেন সায়ন সরকার। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি। 
...................

শেষ মৃত পাখি
সুপ্রকাশ
মুদ্রিত মূল্য ₹৫২০
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

পঁয়তাল্লিশ বছর আগে দার্জিলিঙের এক সম্ভাবনাময় কবি, অমিতাভ মিত্র খুন হয়েছিলেন। অভিযোগের তীর ছিল তাঁরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু রহস্য-ঔপন্যাসিক অরুণ চৌধুরীর দিকে। কিন্তু নানা পরস্পর বিরোধী প্রমাণে সে অভিযোগ দাঁড়ায়নি।
তনয়া একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক। অমীমাংসিত খুনের কাহিনী নিয়ে ধারাবাহিক লিখছেন পত্রিকায়। অমিতাভ মিত্রের হত্যা-রহস্য নিয়ে লেখার জন্য দার্জিলিঙে এলেন তনয়া। তারপর? তনয়া কি খুঁজে পেলেন এই হত্যারহস্যের সমাধান?

জাপানের হনকাকু ঘরানার থ্রিলার নিয়ে আলোচনা করতে করতে এই উপন্যাসের একটি চরিত্র আরেক চরিত্রকে কথাচ্ছলে বলেন ".... সাহিত্য না থাকলে শুধু শুকনো মগজের খেলা কতক্ষণ ভালো লাগে মানুষের??"
আর ঠিক এই জায়গাতেই"শেষ পাখি মৃত" অন্য সমস্ত থ্রিলার থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা। ব্যোমকেশের পর বাংলায় সাহিত্যমুখী থ্রিলারের বড্ড অভাব, থ্রিলার সাহিত্য বলতে আমরা যা পেয়েছি তা হল "... গোয়েন্দা গল্পের মধ্যে ধাঁধা, লকড রুম রহস্য, একলা বাড়ির ভেতর খুন, এরকম নানাবিধ দুরুহ সমস্যা এনে প্রায় অংকের নিয়ম সাজিয়ে সাজিয়ে সমাধান, যেখানে সাহিত্য কম বরং সমাধানের মজা বেশি...."।
এরই মাঝে মাঝে আমরা দু-একটি বই এমন পেয়েছি যেগুলি সত্যিই ব্যতিক্রমী থ্রিলার। রাজর্ষি দাশ ভৌমিক এর গোয়েন্দা কানাইলাল সিরিজ অথবা পিয়া সরকারের দর্শনা বোস সিরিজ সত্যিই ভীষণ ভালো কাজ, কিন্তু শাক্যজিৎ বাবুর এই বই সম্পূর্ণ অন্য জাতের।

সত্তরের দশকের এক সম্ভাবনাময় কবির হত্যারহস্য নিয়ে তদন্ত করতে উনপঞ্চাশ বছর পর দার্জিলিং এ আসেন এক সাংবাদিক। তনয়ার নিজের ভাষায় তিনি সমাধান খুঁজছেন না, তিনি খুঁজছেন একটি স্টোরি। এবং তার এই স্টোরি খোঁজার সূত্রে তিনি একটি নয় পেয়ে যান দু-দুটো গল্প, দু দুটো আনসলভড মিস্ট্রি। একটি গল্পে রয়েছেন অমিতাভ মিত্র, অরুণ চৌধুরী, ড্যানিয়েল লামা, ধনরাজ গম্বু প্রভৃতি চরিত্র, আর একটি গল্পে রয়েছেন শুদ্ধসত্ত্ব, প্রণবেশ, মাধব রক্ষিত, আনিসুর, বিমলবাবু। এ এক গল্পের মধ্যে আরেক গল্প। একটি গল্পের রহস্য সমাধান আরেকটি গল্প ছাড়া সম্ভব নয়। পড়তে পড়তে কখনো মনে হতে পারে অ্যান্থনি হরওয়িজ এর ম্যাগপাই মার্ডারস পড়ছেন, সেই গল্পের মধ্যে গল্প, কিন্তু বিশ্বাস করুন বইয়ের শেষে বুঝতে পারবেন "শেষ মৃত পাখি" সম্পূর্ন আলাদা এবং ব্যক্তিগত ভাবে ম্যাগপাই মার্ডারস এর থেকে অনেক অনেক ভালো একটি বই। কারণ এই দুই গল্পের মাঝে আছে উত্তাল সত্তর, তার লিটল ম্যাগাজিন, তার বীতশোক ভট্টাচার্য, অমিয়ভূষণ মজুমদার, নিশীথ ভড়, তুষার, এবং তার নকশাল আন্দোলন। সত্তর দশক ছাড়াও এই গল্পের আরেক প্রধান চরিত্র বর্ষার দার্জিলিং, যে দার্জিলিংয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক ম্যাজিক রিয়ালিজম এর আশ্রয় নিয়েছেন। পাহাড়ের ধারে সেই কালো ঘোড়া বহুদিন মনে থাকবে। 

আর এই গল্পের মিষ্ট্রি বা সাসপেন্স এলিমেন্ট, শেষ দশ পাতা আগেও ধরতে পারবেন না কি হচ্ছে। ওই যে দুটো ইন্টার ডিপেন্ডেনট রহস্য আর তার সাথে থ্রি লেয়ার্ড সমাধান। 

৪০০ পাতার একটি থ্রিলার উপন্যাস শেষ কবে বাংলায় বেরিয়েছে আমার মনে নেই, কিন্তু থ্রিল এবং সাহিত্যের এই মিশেল, দু দিনে এই বই শেষ করতে বাধ্য করেছে। এই বছর, এই দশক এবং এই শতকের সেরা থ্রিলার। পিরিয়ড।

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।