দুর্লভ খুদকুড়ো ৬। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

সুপ্রকাশ প্রকাশিত দুর্লভ সূত্রধরের ‘আহাম্মকের খুদকুড়ো’র ধারাবাহিক পাঠ-আলোচনা লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী। আজ ষষ্ঠ পর্ব।
তাঁর অনুমতি নিয়ে আমরা নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি। এমন পাঠ-আলোচনাও দুর্লভ। 
..........................................
একটি ধারাবাহিক পাঠালোচনা 
 ৬
 বড়ো হয়ে যাওয়ার বেদনা 

১৯৭১। এই উপমহাদেশের চিরস্মরণীয় সেই বছর। ওপারে বাংলা ভাষা মুক্তির জন্যে লড়ছে। এপার বাংলাও আবেগে উত্তাল। ওপার থেকে শরণার্থীরা দলে দলে এপারে আসছেন। খেলার মাঠ, ইস্কুল-কলেজে তাঁদের ঠাঁই দিতে গিয়ে খেলাধুলা, পঠনপাঠন বন্ধ। তবু মানুষ বিরক্ত নয়। 
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাশি রাশি লেখা হয়েছে, এখনও হয়ে চলেছে। দুর্লভ সুত্রধরের কলম মুক্তিযুদ্ধের বহুচর্চিত রাজনীতি এবং বীরত্ব-ত্যাগ, বা কদর্যতা-বীভৎসতা থেকে সরে এসে যুদ্ধ-সময়ের বিশেষ ‘পরিস্থিতি’র উপর স্থির হয়েছে; যে পরিস্থিতিতে ‘ছেলেরা দ্রুত বড়ো হয়ে যায়’। বয়ঃসন্ধিকাল পেরিয়ে যাওয়ার পথে ছেলেদের হৃদয়ের গোপন রক্তক্ষরণকে লেখকের কলম ছোটো ছোটো বিধুর অক্ষরমালায় সাজিয়ে দিতে থাকেন। 
মুক্তিযুদ্ধের সাহায্যার্থে কৌটো নাচিয়ে চাঁদা সংগ্রহ করার জন্য রিপাবলিকের পাবলিকদের যে দলটি পথে নেমে হাটেঘাটে ঘুরে বেড়ায়, দেবেশ্বর তার স্বঘোষিত ‘মেজর’। তার দাদা শিবেশ্বরের বন্ধু, ওপার বাংলার এক বিখ্যাত কবি সেই ‘পরিস্থিতি’তে এসে আতিথ্য নেন তাদের বাড়িতে। সঙ্গে কবির ‘সিনেমা-সুন্দরী’-বোন, আমীরা। দেবেশ্বরের বাড়ির সামনে ‘একা একা দাঁড়িয়ে আছে’ যে কাঁঠালগাছটি, তার ছায়ায় বসে দেবেশ্বরের যে-বন্ধুরা আমীরার হাসি-কথা শোনে, বাড়ি ফেরার পথে ‘ঘন চক্কর’ লাগা মাথায় সহসা তারা আবিষ্কার করে ‘কোন পরিস্থিতিতে এবং কেন দেবাটার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না’! 
তারপর একদিন যুদ্ধ জয় হয়। সেই জয়কে অভিনন্দন জানিয়ে রিপাবলিকের প্রথম প্রেয়ারেই হেডস্যার বলেন – ‘স্বাধীনতা বেঁচে থাকুক আমাদের ইচ্ছার মধ্যে’। কিন্তু আমীরা ফিরে যায় তার দাদার সঙ্গে নিজেদের স্বাধীন দেশে। আর এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিষাদের আল্পনা মেখে দেবেশ্বর বসে থাকে বেজনা বিলের ধারে। যেন ‘একটা কুসুম-কুসুম গন্ধ, শব্দহীন কবোষ্ণ এক ছায়া, মোমের মতো মসৃণ দর্শনাতীত-স্পর্শাতীত এক অনুভূতি – এসবের গভীরে এক অপ্রতিরোধ্য বেদনা তাকে ভাসিয়ে নিতে চাইছে বিম্বিত বিলের জলে।’
যা একদিন অঙ্কুরিত হয়েছিল সরস্বতী পূজায়, রাস্তায় ‘আগুন’-এর পিছু পিছু ‘ঘি’ কে গড়িয়ে যেতে দেখে এবং কোনো এক শুক্ল পক্ষের শেষদিনে ‘সলাজ-চোখদুটির দিগন্তে নেমে আসা পল্লব’ বেয়ে, সেই ‘কৃষ্ণ-অরূপতা’ বিবর্তনের পথ ধরে এইভাবেই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সম্মোহনের ঝটকা দিয়ে যায়। সেখানে দেবেশ্বরের সঙ্গে বরুণের হৃদয় এসে মিলে যায়; যে বরুণ ঝুড়িবিক্রেতার বাঁশি নামের বেতসলতা মেয়ের ‘নাকছাবিটির ছিলা-কাটা বিন্দু পাথরে অরোরার ছটা’ দেখতে পায়। 
আহাম্মকের হৃদয়ের খবর, লেখক লুকিয়ে রাখার যতই ভান করুন ‘দরজার বাইরে দরজা’ খুলে দেখলেই পাঠক তা টের পেয়ে যাবেন। কিন্তু তার আগে ‘বারোয়ারি প্রণবদা’র হৃদয় মাড়িয়ে যেতে হবে। প্রণব পাড়ার আবালবৃদ্ধবনিতার আস্থাভাজন। ঝুলনসজ্জার শিল্পী প্রণব, অনুরাগী ভাইদের কাছে রাখী পূর্ণিমা ‘প্রণব দিবস’ নামে উদযাপিত, দিদি-বৌদিদের আদরের ভাই প্রণবের দুই হাত-ভর্তি রাখী । কী যে হতো যদি না পাড়ার  ষোড়শী বা অষ্টাদশীরা রাখীর দিনে তাঁকে এড়িয়ে চলত! নামকরা ঘুড়ি-ওস্তাদ এই প্রণবের নির্ভার জীবনও একদিন প্রবল ঝটকা খেল, তার হৃদয়-ঘুড়িকে ভো-কাট্টা করে তার নিজের হাতে গড়া সরস্বতী প্রতিমা-সদৃশ  মুখটি একদিন অদৃশ্য হয়ে গেল। সেই ঝটকার ছাপ পড়ল না তার চোখে মুখে, সে কেবল ‘থোপা থোপা মেঘের পাশে’ উড়তে থাকা ‘দিন-রাত্তির’ ঘুড়ির পাশে “শেষ বিকেলে সাঁ সাঁ করে উড়িয়ে দিল ‘মোমবাতি’।”
তো প্রণবদার কাটা ঘুড়ির পিছন পিছনই আরও একটি ছেলের হৃদয় মাড়িয়ে উধাও হয়ে গেল আরও একটি প্রতিমা। কে ‘সেই ছেলেটি’? যে ছেলেটি “আ-কৈশোর ত্বকের ভেতরে সেই বালিকার মুকুল-মুকুল গন্ধকে লালন করেছিল – নিজের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে ঝিম্-ধরানো নৃত্যের ছন্দকে অভিযোজিত করেছিল সে। সেই ছেলেটিই একমাত্র বুঝতে পেরেছিল – ‘বেদনার পরম গোপন কথাগুলি’ – যে-কথা কাউকে বলা যায় না, কারোর সঙ্গে ভাগ করা যায় না।” 
পাঠক আন্দাজ করুন ছেলেটির পরিচয়। নেপথ্যের গল্পগুলির আভাস দিলাম মাত্র। আলোচকের বিস্ময় কেবল থমকে রইল লেখকের বয়সন্ধির হৃদয়-বেদনাকে প্রকাশ করার মনোহারিত্বে! 
(চলবে)

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।