দুর্লভ খুদকুড়ো ৭। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

সুপ্রকাশ প্রকাশিত দুর্লভ সূত্রধরের ‘আহাম্মকের খুদকুড়ো’র ধারাবাহিক পাঠ-আলোচনা লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী। আজ সপ্তম ও শেষ পর্ব।
তাঁর অনুমতি নিয়ে আমরা নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি। এমন পাঠ-আলোচনাও দুর্লভ। 
.................................
একটি ধারাবাহিক পাঠালোচনা
রূপেশ্বরী ও না-লেখক হওয়ার বৃত্তান্ত

নদীর নাম রূপেশ্বরী। সে যেন এক রূপকথার নদী। দুর্লভ স্মৃতি-পরিক্রমা ‘পোড়ের ভাত’ থেকে উজিয়ে এসে যেমন এই নদীটির ঘাটে এসে থামে; ঠিক তেমনি করেই লেখকের সাহিত্য পাঠ-পরিক্রমাও ‘দাদুর দস্তানা’ থেকে দীর্ঘ বিবর্তনের পথে ‘ইস্পাত’-এসে স্থির হয়, সেই বইটি লেখকের ব্যক্তি-‘জীবনের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা অসম্পন্নতার মালিন্যভরা অর্থহীন সংকীর্ণ পরিসরটিকে ভেঙে দিতে’ চায়, জাগিয়ে দেয় ‘বেদনার অচিহ্নিত রেখাগুলিকে’। সেই রেখাগুলি আবিষ্কার করে মা মণিবাবু স্যারের কথারই যেন প্রতিধ্বনি করেন, - বেদনার কথা ‘যদি বলতেই হয় নদীর কাছেই বলা যায়। নদী সব শোনে তারপর সব দুঃখ নিয়ে বয়ে চলে যায়,…’। ফলত নিকোলাই অস্ত্রভ্স্কির ‘যৌবন, ভালোবাসা আর সংগ্রাম’-কে বুকে নিয়ে আহাম্মক এই নদীটির কাছে এসেই দাঁড়ায়।
রূপেশ্বরীর খেয়াঘাটে বসে এপার ওপার পারাপার করা জীবন দেখে আহাম্মক। সেই রূপেশ্বরীর আঁচলে বাঁধা ‘তিন ভুবনের ম্যাজিক’। “এপারে জীবন ওপারেও জীবন, এপারে জীবিকা ওপারেও জীবিকা। এ-দুয়ের টানেই যেন ‘দুই পাড়েতে’ যাওয়া-আসা – সারাদিন হা-ক্লান্ত নৌকো বাওয়া?”
এপার ওপারের যাত্রী সে এক শ্যাম ঘোষ, স্কুল ফাইনাল পাশ, রিপাবলিকের ফুটবল দলের একদা দুর্ধর্ষ ডিফেন্ডার, বর্তমানে পঞ্চাশোর্ধ্ব দুধ-ব্যবসায়ী। তার শরীর যেন ‘কৃষ্ণস্থাপত্য’, সেই মোহেই একদা এক রূপসী নগরনন্দিনী তাকে মন দিয়েছিল, প্রেমাস্পদ ও দারিদ্র্যকে বরণ করেছিল। মোহ ভাঙতে দেরি হয়নি। বছর ঘুরতেই সে ফিরে যায় নাগরিক স্বাচ্ছ্যন্দ্যের জীবনে। তখন থেকে একাকী শ্যামের ধূসর জীবন কেবলই দুধের ড্রাম নিয়ে এপার ওপার। ফেরার পথে তার গলায় বাজে আকুতিভরা গান – “ও আধে গো, চইলা গেলি কেনে? … কোন সুখেরই টানে …”।
এই রূপেশ্বরীর ধারেই মণিবাবু স্যারের বাড়ি। যে-মণিবাবু উদাসীন গলায় বলতে পারেন - “সাহেব বাংলোর সামনে যে দেবদারু বীথি আছে, জ্যোৎস্না রাতে সেখানে একা হাঁটলে কবিতার জন্ম হবে”, সেই মণিবাবুর সংসারে বৃদ্ধ, অসুস্থ মা-বাবা, বিধবা পিসি আর কাকা-কাকিমা। তাঁর একার রোজগারে চলা ভাঙাচোরা সংসারে তাঁর স্ত্রী হন্যে হয়ে ছুটে বেড়ান, মুখে পরিশ্রমের স্বেদ। ‘চারপাশে মলিন অপরিচ্ছন্নতা’।
‘স্বপ্নভুবনের বিপরীতে’ এভাবেই বসে থাকে বাস্তব। তাকে ভুলতেই তিনি বুঝি ‘সাত-রঙা ময়ূরপঙ্খীতে পাল তুলে দিয়ে’ তাঁর ছাত্রদের নিয়ে যেতে চাইতেন ‘দূর দূর অচেনা বন্দরে, না-জানা জনপদে’।
এই সব চাওয়ার অভিঘাতে নিজেকে মেলে ধরার ইচ্ছে জাগে আহাম্মকের, তা সে ডানা মেলে না হোক, কাগজের উপর কলমের আঁচড় কেটেও তো নিজেকে মেলে ধরা যায়। এই মেলে ধরার নেশা পেয়ে বসা মানেই ‘তার দাহ চিরকাল’। দাহই সার। বৃহত্তর ‘জীবনের সঙ্গে নিজের ব্যক্তি জীবনকে মিলিয়ে এগিয়ে চলার’ যে লক্ষ্য ‘ইস্পাত’-এর নিকোলাই অস্ত্রভ্স্কির বোধে সঞ্চারিত হয়েছিল, তা আহাম্মককে যতই আন্দোলিত করুক, তার সেরকম কিছু হয়ে উঠল না জীবনে। রূপেশ্বরীর নির্লিপ্ত বয়ে চলার মতোই লেখকের বুকের ভেতরে আহাম্মকটা যেমনকার তেমনই থেকে গেল।
লেখকের না-লেখক হয়ে ওঠার এই আক্ষেপকে পাত্তা দেবেন না, পাঠক। গ্রন্থের শেষে আহাম্মকের ‘…আমি তো আছি, আমি তো থাকছিই’ শুনে বরং আশ্বস্ত থাকুন আপনি। আহাম্মক থেকে যাওয়াটা লেখক হয়ে ওঠার চাইতে কিছু কম কাম্য নয়। আহাম্মকের স্মৃতিকথা শেষ অব্দি আপনাকে সেই প্রতীতির আলোয় পৌঁছে দেবেই।
সুপ্রকাশের আরও একটি অসাধারণ কাজ, যুগলবন্দীতে সৌজন্য চক্রবর্তীর প্রচ্ছদ। স্বয়ং লেখকের করা অলংকরণ পাঠককে বাড়তি তৃপ্তি দেবে। পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৮৯, মুদ্রিত মূল্য ২৮০ টাকা।

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।