সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।। সুপ্রকাশ
"চা-বাগিচায় কুলি চালান এবং বাগিচা অঞ্চলে কুলিদের ওপর অত্যাচার নিয়ে নানান আখ্যান ও ইতিহাস আছে। সেসব প্রধানত আসাম এলাকা নিয়ে। তুলনায়, দার্জিলিংয়ের বাগিচা-শ্রমিকদের অবস্থা প্রসঙ্গে সমসাময়িক লেখাপত্র না-থাকার মতনই। সত্যি কথা বলতে কি, বেসকির বইটা বেরুনোর আগে অবধি শ্রমিকদের দৈনন্দিন জীবন এবং বাগিচার শ্রম-সম্পর্ক নিয়ে লেখাজোখা আদৌ হয়েছে কি? ভাবতে ভাবতে একটা লেখার সন্ধান পাওয়া গেল। দার্জিলিংয়ের অন্য বহু কিছুর মতো সে লেখাও অধুনা বিলুপ্ত, যিনি লিখেছিলেন তাঁর নামও বিশেষ কেউ মনে রাখে না।
অথচ, ভারতবর্ষের রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের ঠিক আগেপরে দার্জিলিংয়ের বাগিচা শ্রমিকদের অবস্থা, তাঁদের অসংখ্য লড়াইসংগ্রাম, মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক, সরকার বা রাষ্ট্রের ভূমিকা কি, এসব জানবার জন্য লেখাটা পড়া বিশেষ প্রয়োজন। 'কাঞ্চনজঙ্ঘার ঘুম ভাঙছে' নামের এই লেখা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৩-য়, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি থেকে। লেখক সত্যেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার দার্জিলিং অঞ্চলে ও বাংলায় কমিউনিস্ট দলের আদি সংগঠকদের অন্যতম, তিনি জেলে বসে পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেন। স্বাধীনতার পরপরই, কমিউনিস্ট দল যখন 'ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়' স্লোগান তুলে দেশে বিপ্লবযুদ্ধের ডাক দিচ্ছে, এবং ফলে গোটা দলটাকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করছে সরকার, সত্যেন্দ্রনারায়ণ দার্জিলিংয়ের এ বাগান থেকে ও বাগান পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, শ্রমিকদের আশ্রয়ে থাকছেন। তাঁর লেখায় সে সব কাহিনী বিস্তারিত ভাবে বলা আছে। এই লেখাটাই আরো গুছিয়ে, সংহত করে সত্যেন্দ্রনারায়ণ দ্বিতীয় একটি লেখা প্রস্তুত করেন ১৯৬৩ সালে। মনীষা গ্রন্থালয় থেকে সে বই 'পটভূমি কাঞ্চনজঙ্ঘা', নামে প্রকাশিত হয়। এই দুটো বই একসঙ্গে পড়লে গত শতাব্দীর শেষ-চল্লিশের দশকে দার্জিলিংয়ের চা-বাগিচা শ্রমিকদের দিনযাপন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়।
দার্জিলিংয়ের চা-বাগিচা অঞ্চলে চা-কর প্ল্যান্টার সায়েবদের নিশ্ছিদ্র জমিদারি চলতো। সব বাগিচাতেই চলতো, চায়ে যেমন, সিঙ্কোনায়, সরকারি সংরক্ষিত বনেও। শ্রমিকদের মজুরি নামমাত্র, কোথাও কোথাও তাও নেই, বিনি মজুরিতে কাজ করতে হতো, যেমন টঙিয়া গ্রামগুলোয়। সমতলের অনেক চা-বাগিচায় শ্রমিক পরিবারেরা খালি, অর্থাৎ, চা গাছ নেই এমন জমিতে চাষবাস করতেন। পাহাড়ে সে সুযোগ কম, এমনিতেই চাষযোগ্য জমির স্বল্পতা, উপরন্তু বাগিচা মালিকেরা জমি খালি না রেখে পুরোটাতেই গাছ লাগাতেন। ফলে নেপাল থেকে যে শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় কিংবা কুলিচালান হয়ে দার্জিলিংয়ে পৌঁছোতেন, তাঁদের সবার কেন, অধিকাংশের কপালেই চাষজমি জুটতো না। কম জমির সমস্যা অন্য বাগিচাতেও ছিলো, এখনো আছে। পাহাড়ের টঙিয়াগুলোয় অদ্যাবধি বাস করেন যে পরিবারেরা, তাঁদের বেশিরভাগেরই নিজস্ব জমি বলতে ঘর লাগোয়া এক চিলতে উঠোন, সেখানে বড়জোর কিছু শাকসবজি ফলানো যেতে পারে। চা বাগিচাগুলোয় এখন সেটুকু জমিও অমিল, বাড়ির গায়ে, পিছনে, উপরে বাড়ি উঠছে তো উঠছেই, চাষ হবে কোথায়?
কোনরকম মাথা গুঁজে থাকার মতো এক টুকরো জমি, কুলি সর্দারদের বানিয়ে দেওয়া কুঁড়ে। মজুরি না থাকার মতোই। বাংলার চা-শ্রমিকদের নিয়ে বিশেষ মূল্যবান এক গবেষণাপত্রে, ইফতিকার উল আওয়াল পুরোনো প্ল্যান্টার্স গেজেট ও ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ইন্ডিয়া অফিস রেকর্ডস ঘেঁটে উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের প্রথমে চা-শ্রমিকদের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে অনেক তথ্য হাজির করেছেন। দেখা যাচ্ছে, ১৯০০ সালে দার্জিলিংয়ের চা শ্রমিকদের গড় মাসিক মজুরি, ছেলেদের ক্ষেত্রে ৫ টাকা ৮ আনা থেকে ৬ টাকা অবধি, মেয়েদের আরো কম, ৪ টাকা ৮ আনা। ১৯১৫ সালে ডুয়ার্সের বাগিচায় মাসিক মজুরি নির্ধারিত হচ্ছে, তরাই সমেত দার্জিলিং জেলায় মজুরি যা ছিল তাই। ইফতিকার বলছেন, প্রকৃত মজুরি আরো কম, কেননা ১৯০৬ থেকে জিনিসপত্রের, বিশেষত খাদ্যশস্যের দাম বাড়ছিল। যে চাল মণপিছু ৩ টাকায় পাওয়া যেতো, তার দাম গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ৭ টাকা, দুর্ভিক্ষের সময় ১০ টাকা। ভুট্টা পাওয়া যেত মণপ্রতি ১২ টাকায়, ২ থেকে ৪ টাকা করে বেড়ে গেলো সেটাও। যে পরিবারের মাসিক আয় কূল্যে ১৬ থেকে ২০ টাকা, তাদের দিন চলে কী করে? কোনো কোনো বাগিচা, যেমন তাকদার নীচে তিস্তা ভ্যালি, কুলিদের চাষের জমি দিল, যাতে তারা চাষ করে অন্তত খেতে পারে। ইফতিকার দেখাচ্ছেন, এতে আশপাশের অন্য বাগানগুলোর তীব্র আপত্তি, এক তো তাদের দেবার মতো জমি নেই, দ্বিতীয়ত, জমি না থাকার ফলে কুলি জোটানোতে অসুবিধা।
যুদ্ধ অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মজুরি কিছুটা হলেও বাড়লো। ১৯৩১-এ প্রকাশিত রাজকীয় শ্রম কমিশনের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ১৯২৯-এ দার্জিলিংয়ের বাগিচা শ্রমিকদের ন্যূনতম দৈনিক আয়, ছেলেদের ক্ষেত্রে ৭ আনা ৬ পাই, মেয়েদের ৬ আনা, বাচ্চাদের ২ আনা ৯ পাই।
বাগিচাশ্রমিকদের চিকিৎসার সংস্থান ছিল না। সমতলে যেমন শ্রমিকমৃত্যু ঘটতো পালাজ্বরে আর কালাজ্বরে, পাহাড়ে ছিল টিবি, অন্য শ্বাসজনিত রোগ, এমন-কী কলেরা। বাগিচা-মোচ্ছবের প্রথম দিকটায় প্ল্যান্টাররা কুলি বিষয়ে এতটাই নিশ্চিত ছিল (কুলি মরলে আর কী! আবার আসবে), ১৮৭২ সালে বাংলা সরকার দার্জিলিংয়ে আইন চালু করে (আইনটা ছিলই, তবে অন্য আরো বহু আইনের মতো, দাজিলিংয়ে চালু ছিল না) শ্রমিকদের জন্য হাসপাতাল তৈরি করাতে তাদের বাধ্য করাতে চাইলে, হুলুস্থুল বেঁধে যায়। দার্জিলিংওয়ালাদের বক্তব্য ছিল, তাদের স্বাধীনতায় এতদ্বারা হস্তক্ষেপ হচ্ছে, তাছাড়া আসাম এবং কাছাড়ের তুলনায়, দার্জিলিংয়ের শ্রমিকরা অনেক ভালো আছে, যা চিকিৎসার দরকার প্ল্যান্টাররা বুঝে নেবে। ফলে কলেরায় বেঘোরে এবং বিনা চিকিৎসায় শ্রমিকরা মরলেন, প্ল্যান্টারতোষক দার্জিলিং প্রশাসন দাঁড়িয়ে দেখল। দার্জিলিংয়ের বাগিচা-মালিকেরা কোনো অবস্থাতেই সরকারকে বাগিচা অঞ্চলে ঢুকতে দিতে রাজি ছিল না। ১৮৭৫-এ পাহাড়ের নীচেকার তরাইয়ে কিছু প্ল্যান্টার সরকারকে বলে, আইন মোতাবেক বাগিচা-মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে চুক্তি করার ব্যবস্থা হোক, নইলে কুলি পালিয়ে যাচ্ছে। দার্জিলিং পাহাড়ের প্ল্যান্টারেরা গররাজি, পাহাড়ে প্রচুর কুলি, তাদের বক্তব্য।
পাহাড়ের চা-বাগিচায় পুরোনো ধাঁচের সায়েবশাসন চালু ছিল দীর্ঘদিন। সায়েবরাও ছিল। বাগিচার (চা, কফি, রাবার) অবস্থা খতিয়ে দেখার জন্য ভারত সরকারের তৈরি তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিশন (১৯৫৪-য় গঠিত) চা নিয়ে তাদের সুদীর্ঘ রিপোর্ট প্রকাশ করে ১৯৫৬-য়। ইতিপূর্বেই বাগিচা শ্রমিক আইন পাশ হয়েছে ১৯৫১-য়, চা ব্যবসা ও বাগিচার ওপর রাষ্ট্রের নজরদারি আইনসিদ্ধ করবার জন্য ১৯৫৩-য় এসেছে ভারতীয় চা আইন। স্বাধীন ও নতুন ভারতে রাষ্ট্র শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের মধ্যিখানে নিজেকে ঢোকাতে চাইছিল।"
....................................................
সময় ভ্রমণ
দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা
সৌমিত্র ঘোষ
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত, শুভশ্রী দাস
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
মুদ্রিত মূল্য : ৫৬০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment