দেয়ালের লেখা : এক অন্তহীন প্রকীর্ণ শিল্পকথা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ

বাংলার সর্বকালের অন্যতম সেরা শিল্পী জয়নুল আবেদিন (১৯১৪-১৯৭৬) তো প্রকৃত অর্থেই গণশিল্পী ছিলেন। দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা তাঁকে খ্যাতিই শুধু দেয়নি, সময়-দেশ-মানুষকে শিল্পীরা কোন দৃষ্টিতে দেখতে পারেন তার এক সার্বজনিক মডেলও তৈরি করেছে। সস্তার কাগজে তুলি বা ব্রাশ আর কালি দিয়ে আঁকা ৪৩-এর মন্বন্তরের এই চিত্রকলার সবটাই পোস্টারের ভাষাকে শিল্পভুবনের ভাষায় পরিণত করেছে। তাঁর মুক্তিযোদ্ধা ছবিটিতে পোস্টারের শিল্পভাষা উৎকীর্ণ হয়েছে, এমন কী ৩০ফুট দীর্ঘ স্ক্রোল ‘মনপুরা ৭০’ ছবিটিকেও একটি অতিকায় পোস্টার বলা যায়।

সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযুদ্ধের সময় সৃজনশীল রাজনৈতিক পোস্টারের জোয়ার দেখা দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণামূলক পোস্টার অঙ্কনে নিতুন কুণ্ডু (১৯৩৫-২০০৬ / পুরো নাম : নিত্যগোপাল কুণ্ডু), প্রাণেশকুমার মণ্ডল, দেবদাস চক্রবর্তী প্রমুখর নাম করা যায়। প্রাণেশকুমার আঁকেন ‘বাংলার মায়েরা মেয়েরা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা’ এবং নিতুন কুণ্ডু আঁকেন ‘সদা জাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী।’ প্রথমটিতে শাড়ি-পরা রাইফেল হাত-ধরা বাঙালিনী, অন্যটিতে পুরুষের হাতে-ধরা রাইফেল―দুটিতে দুই মুক্তিযোদ্ধার স্কেচ। দেবদাস চক্রবর্তী যে পোস্টারটির ডিজাইন করেছিলেন তাতে মন্দির, মসজিদ, মঠ ও গির্জার সারণিকৃত সিল্যুয়েট ছিল। কমলা জমিতে নতুন ভোরের মতো সাদা রিভার্সে লেখা ছিল―‘বাংলার হিন্দু / বাংলার খৃষ্টান / বাংলার বৌদ্ধ / বাংলার মুসলমান’ আর সিল্যুয়েটের নিচে ‘আমরা সবাই / বাঙালি’ বাক্যটি প্রত্যয়দীপ্ত শপথের মতো ব্যবহৃত হয়েছিল। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঢাকা কর্তৃক পুনর্মুদ্রিত॥ এখানে দেবদাস চক্রবর্তী অঙ্কিত পোস্টারটির নিচে শিল্পীর নাম মুদ্রিত আছে। কিন্তু শুভেন্দু দাশগুপ্ত সম্পাদিত ‘বাংলা পোস্টার দুই বাংলার লেখা ও ছবি’ গ্রন্থে এটি আমিনুল হাসানের অঙ্কিত বলে নির্দেশ করা হয়েছে)

আরেক খ্যাতনামা শিল্পী কামরুল হাসান (১৯২১-১৯৮৮) মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খানের ভয়ঙ্কর এক মুখাবয়ব এঁকে ছিলেন। এই পোস্টারের বয়ানে ছিল স্পষ্ট ঘোষণা  ‘এই জানো.য়ারদের / হ. ত্যা করতে হবে।’ এরই ইংরেজি বয়ান ‘অ্যানাইহিলেট / দিজ ডেমনস্। স্বাধীনতার পর স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনকালকে ব্যঙ্গ করে কামরুল হাসান (তাঁকে পটুয়া বলে ডাকা হতো)-এর স্কেচ ‘দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে’ এরশাদবিরোধী গণআন্দোলনে অন্যতম শক্তিশালী পোস্টারমাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কাজী হাসান হাবিব (১৯৪৯-১৯৮৮)-এর আঁকা ‘বাংলাদেশ বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে’ একটি সাড়া-জাগানো পোস্টার। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী (১৯৩২-২০১৪) পোস্টার ডিজাইনে অন্য মাত্রা যোগ করেছিলেন। গ্রাফিককলার নিরীক্ষামূলক ব্যবহার, টাইপোগ্রাফির সুষম বিন্যাস, রঙের উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরীক্ষা, ভাবে, ভাষায় অনন্যতা কাইয়ুমের পোস্টারকে শিল্পচিহ্ন দিয়েছে―‘পোস্টারে প্রচারণাই লক্ষ্য। জনগণকে কিছু জানানোই এর মূল কাজ। কাইয়ুম শুধু এই জানান দেওয়ার পোস্টারে আগ্রহী ছিলেন না। অমন পোস্টারে মানুষ একবার দেখেই তাকে ছেড়ে হেঁটে চলে যাবে। কাইয়ুম চান তাঁর পেইন্টিংয়ের সামনে মানুষ যেমন দাঁড়িয়ে ভাবে, ঠিক সেভাবে পোস্টারের সামনেও দাঁড়াবে ও ভাববে। টাইপোগ্রাফি আর ক্যালিগ্রাফির খেলা দেখেই বিমোহিত হবে মানুষ, পোস্টারের রং, প্রতীক কিংবা মোটিফ গেঁথে নেবে মনে।’ (মইনুল ইসলাম জাবের : ২০২২) এই ছিল তাঁর পোস্টার নির্মাণের লক্ষ্য। ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য পোস্টার ছিল, মুক্তিযুদ্ধের কাল পেরোবার পরই তিনি পোস্টার রচনায় মনোযোগ, মেধা ও সময় ব্যয় করেন। এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার অভিঘাতলব্ধ পোস্টার থেকে শুরু করে বিপর্যস্ত মানুষের বেদনার চিত্রলিপিসহ বহু আনুষ্ঠানিক পোস্টার রচনা করেন। 

১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নূর হোসেনের শরীরে লেখা ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ শ্লোগান লেখা মানব পোস্টারই হয়তো বাংলা পোস্টারের জগতে সবচেয়ে সাড়া-জাগানো পোস্টার। ঐ বছরের ১০ নভেম্বর নূর হোসেন ‘মানব পোস্টার’ হয়ে স্বৈরাচারবিরোধী বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। নূর হোসেন শহীদ হন, কিন্তু তাঁর মানব পোস্টার কিংবদন্তি হয়ে বেঁচে থাকে মানুষের চিরজয়ী স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষায়! এই সময়ের রাজনৈতিক শ্লোগানও গ্রাফিতিতে পরিণত হয়, যেমন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে লেখা হয় ‘সামরিকতন্ত্রে লাথি মারো, গণতন্ত্র ফিরায়ে আনো।’ 
............................................................
আসছে...
কলকাতা বইমেলা অথবা বইমেলার আগেই...
.
.
.
দেয়ালের লেখা : এক অন্তহীন প্রকীর্ণ শিল্পকথা
অনন্ত জানা 
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী

সুপ্রকাশ
         


Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম।। অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। সুপ্রকাশ।।

চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে।। অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।