একটি শিশির বিন্দু।। (বজবজ ও বাটানগর সংলগ্ন অঞ্চলের ছুঁয়ে দেখা গল্প-কথা-রাজনীতি-ইতিহাস)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ

"সাতচল্লিশে যে স্বাধীনতা এসেছিল অনেক রক্ত, দাঙ্গা আর দেশভাগের মিথ্যেকে সঙ্গে নিয়ে, সেই স্বাধীনতারই বছর পাঁচেক পরে বজবজে এসে পৌঁছালেন অদ্ভুত মানুষ একজন। কবি। বিপ্লবী। প্রেমিক। সর্বক্ষণ পায়ের তলায় সর্ষে যেন। এই যে, এখন এই অদ্ভুত এক শূন্যতা ঢাকতে সেই শূন্যতাকে সঙ্গে নিয়েই হেঁটে চলেছে সে সারাক্ষণ— সেই মানুষকেও কি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সেরকমই কোনো শূন্যতা? ক্রমশ সারবত্তা হারিয়ে ফেলা বামপন্থা আন্দোলনই কি কারণ সেই শূন্যতার? একটু কি ফিকে হয়ে আসছে লাল টুকটুকে দিন? তবু, পথ একটু ঘেঁটে গেলেও, লক্ষ্য তো স্থির। লক্ষ্য তো দাঁড়ানো সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষগুলোর পাশে। দেখতে থাকা একটা দেশের আসল জীবনধারা। বছর তেত্রিশের বাঙালি যুবক তাই সদ্য ইউরোপ-ফেরতা স্ত্রীকে নিয়ে এসে উঠলেন এই বজবজে। চড়িয়ালের কয়লা সড়কের কাছেই ব্যাঞ্জনহেড়িয়ায়। মানুষের কাছে কী এত বলার তাঁর? কিংবা এতকিছু নয়, বলার শুধু এটাই যে, 'কমরেড আজ নবযুগ আনবে না?'

'নেমেছিলাম চড়িয়ালে। গ্রাম ব্যাঞ্জনহেড়িয়া। চটকল আর তেলকলের মজুরদের বাস। মাটির ঘর। সামনে এঁদো পুকুর। আঠারো টাকা ভাড়া। দু'জনেই সর্বক্ষণের কর্মী। বিনা ভাতায়। লেখালেখি থেকে মাসে সাকুল্যে আয় পঞ্চাশ টাকা। একে অনিশ্চিত, তাও পাঁচ-দশ টাকার কিস্তিতে। তাই সই। চলো বজবজ।'

আর কী দেখলেন তিনি এসে এখানে?

'কী এক গভীর চিন্তায়
কপাল কুঁচকে আছে
চড়িয়ালের রাস্তা।
একবার এ-আলোর নিচে, একবার ও-আলোর নিচে
গাছের পাতায়
বারবার নড়েচড়ে বসছে
ধৈর্যচ্যুত অন্ধকার।...'

ঠিকানাটা ৭৩ ফকির মহম্মদ খান রোড, গ্রাম ব্যাঞ্জনহেড়িয়া, বজবজ, ২৪ পরগনা। গ্রামের এমন অদ্ভুত নামের কারণ কেউ কেউ বলেন, দু'জন ব্রিটিশ, বেন জন ও হ্যারি সাহেবের বাগান ছিল নাকি এখানে। এই দুই সাহেব আবার হতেও পারেন হাইকোর্টের সেই দু'জন নামজাদা জজ সাহেব, বার্নস পিকক এবং লুই জ্যাকসনও। সেখান থেকেই এমন নাম। আবার, 'হেড়িয়া' শব্দের অর্থ, অঞ্চল। শোনা যায়, প্রচুর সব্জি চাষ হতো একসময় এই এলাকায়। এমন নামের কারণ হতে পারে নাকি সেটাও।

সেই রাস্তার নাম বদলে এখন হাজী মহম্মদ মহসীন রোড। বজবজ থেকে ট্রাঙ্ক রোড ধরে সোজা এগোতে থাকলে, চড়িয়ালের আগেই বাঁদিকে ঢুকছে ব্যাঞ্জনহেড়িয়ার রাস্তা। খানিকটা এগিয়ে যে কোনো কাউকে 'সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি' বললেই দেখিয়ে দেবে আঙুল তুলে। এবং সেই রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলেই, তেলচিটে চাদর বিছানো একটা পুকুর। তার পাশে একটা কালো বেদীর উপর খোদাই করা সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবয়ব। বাইক থেকে নামতে দেখেই যেন স্থানীয়রা বুঝতে পারেন এখানেই থামার উদ্দেশ্য। এবং হাত তুলে দেখিয়ে দেন পুকুরের পাশের বাড়িটা। "ওই বাড়িতেই তো থাকতো।" "আপনারা দেখেছিলেন?” দুই মহিলা হেসে ওঠেন বোকার মতো প্রশ্নে। বিয়ে হয়ে এখানে এসেছেন তাঁরা। তাঁদের স্বামীরাও তখন হয় খুব ছোটো, বা জন্ম হয়নি। "বড় কেউ নেই, যাঁরা দেখেছিলেন?” রং চটা কালো ম্যাক্সি পরা মহিলা এগিয়ে আসেন একজন। বয়স বোঝা যায় না, তবে ভালোই। অনেক ছোটোবেলায় দেখেছেন তিনি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে। আর দেখেছিলেন কালোর মা। বাকি কেউ নেই তেমন এখন আর। "কালোর মা?” “হ্যাঁ, সালেমন বিবি। আছেন এখনও। যাবেন নাকি?” "সালেমন বিবি মানে, 'সালেমনের মা' কবিতার সেই সালেমন?”

এখনকার সাদা রঙের দোতলা বাড়িটার গায়ে ইট, সিমেন্ট, বালি লাগেনি তখনও। যে বার্লিনে জয়ের নিশান উড়িয়েছিল লাল ফৌজ, সেই বার্লিন-ফেরত স্ত্রী গীতাকে নিয়ে পদাতিক কবি উঠেছিলেন ছোট্ট মাটির বাড়ির এই ঠিকানাতেই। পাশাপাশি দুটো ঘর। সামনে চিলতে একটা বারান্দা। আছে এক ফালি উঠোনও। বাড়ির দরজা সবসময়ের জন্য খোলা। রাস্তাই যেন বসবার ঘর। প্রায় আড়াই বছর ধরে চলল একের পর এক কারখানার গেট মিটিং। শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করার কাজও চলছে একনাগাড়ে। সন্ধেবেলাতেও হাজির পার্টি বা ইউনিয়নের অফিসে। অথবা বস্তির সভায়। মাঝের সময়টায় সুভাষ ব্যস্ত ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। নীহার রঞ্জন রায়ের 'বাঙালির ইতিহাস'-এর কিশোর সংস্করণ তৈরির কাজও তো থেমে নেই!

কিন্তু কেন হঠাৎ বজবজে? কেন শ্রমিকদের প্রতি ঝুঁকে পড়লেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়? শুধুই কি পার্টির কথায়? তার আগে ১৯৪৮ সালে নিষিদ্ধ হলো কমিউনিস্ট পার্টি। জেলে বাকি বন্দীদের সঙ্গে অনশন আন্দোলন করছেন সুভাষ। আর মনের ভিতর গেঁথে নিচ্ছেন জেলে বন্দী অন্য শ্রমিকদের জীবনযাপন। গেঁথে নিচ্ছেন তাদের পাঁচালী। আর সেইসব শুনতে শুনতে তাদের জীবনে ঢুকে পড়তে ইচ্ছা করছে ভীষণ সুভাষের। বুঝতে পারছেন তিনি, এই বাংলাকেই নিজের চোখে আরও বেশি করে না দেখলে কীভাবে তৈরি হবে সঠিক সাম্যবাদের ভিত? 'ওপর ওপর বেঁচে থাকা নয়। কোথাও বেশ একটু গভীরে ডুব দিতে হবে।'

বজবজে সেইসময় কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্ব নিয়ে আছেন সন্তোষ ঘোষ। একটু আপোষের পথে হাঁটলেও, কমিউনিস্ট পার্টির পালে জোয়ার লাগতে অসুবিধা হয়নি। সংগঠন শক্তিশালী করার দিকে নজর দিয়ে সাফল্যও পেয়েছিলেন সন্তোষ বাবু। সেই কারণেই পরপর দুটো নির্বাচনে এখান থেকে জয় পেতে অসুবিধা হয়নি বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়ের। এই সন্তোষ ঘোষের সঙ্গেই লেবার পার্টি বা কমিউনিস্ট পার্টির পথে পথ হাঁটা শুরু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের। সুভাষের সেই 'চেনা লোক'-এর মাধ্যমে বজবজে এসেই নতুন দিশা পেয়েছিল তাঁর কবিতা। 'বজবজে এসেই ফুটেছে ক্যাকটাসের ফুল', লিখেছিলেন তিনি পরে।

ব্যাঞ্জনহেড়িয়ায় তখন কুঁড়েঘর এদিক-ওদিক। এঁদো পুকুরের পাশ দিয়ে কাঁচা রাস্তা। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ই লিখছেন, 'পুকুরটা আকণ্ঠ খুঁজে আছে পাতা-পচা ছ্যাতলায়। জলের ওপর যেন কেউ বিছিয়ে দিয়েছে একটা তেলচিটে চাদর। তার মাঝখানে বিজগুড়ি কাটছে বেলফুলের কুঁড়ির মতো অসংখ্য বুদবুদ।' আর সেই পুকুরের পাশ দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে ছোট্ট সালেমন। 'সালেমনের মা' কবিতার সেই ছোট্ট সালেমন বিবি। সেই বেয়াল্লিশ বা তেতাল্লিশের মন্বন্তরের সময়ই জন্ম যাঁর।

কিন্তু বিয়ের একবছরও ঘোরেনি তখনও। কী করে সময় কাটছে সদ্যবিবাহিতা গীতার? অন্যভাবে মিশে যাচ্ছেন তিনিও এই লড়াইয়ে। ভাবছেন, শুধু আন্দোলন করে কী করে এগিয়ে যাওয়া যাবে ভবিষ্যতের দিকে? শিক্ষা ছড়াতে হবে শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে। অবৈতনিক স্কুল খুলছেন গীতা। শ্রমিকদের বাড়ির মেয়েরা অক্ষর চিনবে যেখানে। পড়াশোনা শিখতে আসে সেখানে সালেমনও। আর অন্য সময় প্রায়ই এসে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে তোলে খোদ সুভাষকেই। সঙ্গে বন্ধু সাকিনা। সুভাষ হয়তো লিখছেন তখন।

'কী কর তুমি?' ও জানতে চেয়েছিল আমি পেট চালাই কেমন করে। বলেছিলাম, 'আমি লিখি'। শুনে অবাক হয়ে বলেছিল, 'বা রে, লিখে কেউ টাকা পায় নাকি? লেখাপড়া করতে গেলে তো টাকা দিতে হয়।' খুব মিথ্যে বলেনি, হাড়ে হাড়ে আজ টের পাচ্ছি।'

সালেমনের বন্ধু এই সাকিনাকেই আবার পরে দত্তক নিতে চেয়েছিলেন সুভাষ-গীতা। কিন্তু সাকিনার বাবা-মায়ের আপত্তিতে যদিও সেটা সম্ভব হয়নি শেষ অবধি।"
.................................................
একটি শিশির বিন্দু
(বজবজ ও বাটানগর সংলগ্ন অঞ্চলের ছুঁয়ে দেখা গল্প-কথা-রাজনীতি-ইতিহাস)
................................................
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী

প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল
মুদ্রিত মূল্য : ৩৪০ টাকা 
সুপ্রকাশ


Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম।। অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। সুপ্রকাশ।।

চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে।। অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।