দেয়ালের লেখা : এক অন্তহীন প্রকীর্ণ শিল্পকথা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ
তীব্র রাজনৈতিক অভিঘাতই যে গ্রাফিতি উৎসমুখ খুলে দেয় তার আরও এক বড়ো প্রমাণ পাওয়া যায় গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায়।
এই গৃহযুদ্ধের যৌক্তিকতা, ন্যায্যতা, ঔচিত্য-অনৌচিত্য বিষয়ে তর্ক ও আলোচনা চলতেই পারে, কেননা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধও ছিল তথাকথিত ‘আরব বসন্ত’-এর অন্তর্গত। ২০১০ সাল থেকে পাকিয়ে ওঠা ‘আরব বসন্ত’ আরবীয় দেশগুলিতে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটায়, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোভুক্ত ইউরোপীয় দেশগুলির পরোক্ষ সমর্থন ও প্রত্যক্ষ সক্রিয় সহযোগিতা এবং পশ্চিমী সংবাদমাধ্যমগুলির একতরফা প্রচারের মাধ্যমে ফেনিয়ে তোলা এই বসন্ত আরব দুনিয়ার দেশে দেশে একনায়কতন্ত্রী শাসন (যেমন : তিউনিসিয়ার শাসক জেন এল আবেদিন বেন আলি, মিশরের প্রেসিডেন্ট হোসনে মোবারক, লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গদ্দাফি, ইয়েমেনর রাষ্ট্রপতি আলি আবদুল্লাহ সালেহ প্রমুখ শাসকেরা), ভয়াবহ বেকারি, অর্থনৈতিক দুর্বলতা ও দারিদ্র্য, গণতান্ত্রিকতার প্রতিষ্ঠা, কর্মসংস্থান, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এই সমস্ত প্রতিশ্রুতি শেষ পর্যন্ত মরীচীকায় পরিণত হয়। পশ্চিমী পুঁজিবাদের প্রতিপত্তির সূচনা হয় আরব দুনিয়ায়। বিপ্লবের নামেও যে মানব-ইতিহাসের বিকল্প-বিপথ-যাত্রা ঘটতে পারে আরব বসন্ত তার উদাহরণ হয়ে থাকে। মূলত আরব বসন্তের হাওয়া গায়ে মেখে ২০১১ সালে সিরিয়াতেও শাসকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিবাদ দেখা দেয়। এক দশকাধিকাল চলে আসা গৃহযুদ্ধে প্রচুর মানুষ নিহ ত হন, বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা লক্ষাধিক। আরব বসন্তের কারণে সমগ্র আরব দুনিয়ায় আহ ত ও নিহ তের সংখ্যা কতটা ভয়াবহরূপে বিপুল ছিল, সংখ্যাটা প্রায় পাঁচ লক্ষ বলে অনুমান করা হয়। এর মধ্যে অধিকাংশই যু দ্ধ-হিং সায় মা .রা যান। চিকিৎসার অভাব, আশ্রয়ের বিনষ্টি, খাদ্যাভাবেও বহু মানুষের প্রাণহানি হয়।
এই বিপত্তিই যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় গ্রাফিতির জন্ম দেয়। দিনে বিদ্রোহী যোদ্ধা এবং রাত্রে তরুণ দেয়ালশিল্পী আবু মালিক আল শামি সিরিয়ায় গ্রাফিতিকে নতুন মাত্রা দেন। একটি ভবনের ধ্বংসস্তূপের গায়ে তাঁর আঁকা করোটির স্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে দেয়ালে অঙ্কনরত একটি ছোট্ট বালিকার চিত্রটি বিখ্যাত হয়। বালিকাটি একটিমাত্র শব্দ আঁকছিল―‘হোপ’। ছবিটিতে ব্যাঙ্কসির অঙ্কন-ঘরানার ছাপ স্পষ্ট। এই গ্রাফিতি আল শামিকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। এবং তাঁকে ‘সিরিয়ার ব্যাঙ্কসি’ বলে সম্বোধন করা হতে থাকে। প্রায় দু-বছর ধরে সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসের ১০ কিলোমিটার দূরে দারাইয়া জুড়ে কয়েক ডজন গ্রাফিতি এঁকেছিলেন শামি। মাদার্স ডে উপলক্ষে শামি বেদনার্ত ব্যঙ্গে এঁকেছিলেন সন্তান কোলে বিপন্ন মায়ের ছবি―যাঁর মাথার ওপরে বোমারু বিমানের ওড়াউড়ি, পশ্চাদদৃশ্যে বোমাবিধ্বস্ত শহরের আভাস, আর হ্যাপি মাদার্স ডে-র বার্তা! অপর একটি গ্রাফিতিতে একটি বালিকা সশস্ত্র এক সৈন্যকে হৃদয়ের প্রতীক বা লাভ সাইনের অর্থ শিক্ষা দিচ্ছে। আরেকটি দেয়ালচিত্রে মেশিনগানে বুলেটের পরিবর্তে ফুল ব্যবহার করা হচ্ছে, আরবি অক্ষরে শামি লিখেছেন একটিমাত্র সংক্ষিপ্ত বাক্য―‘এই বছর আমরা ইদ উদযাপন করব কেমন করে?’ আবু মালিক সম্ভবত সেই দলের বিদ্রোহী সৈনিক যাঁরা আরব বসন্তের ডাকে প্রতারিত হয়েছেন। তাঁর একটি গ্রাফিতি সিরিয়ার সংঘাতের পরিবর্তিত ক্রমপর্যায়কে চিহ্নিত করেছে―প্রথমে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ (২০১১ / বেহালা বাদনরত এক স্থূলকায়া মহিলা), শাসকবাহিনীর প্রত্যাঘাত (২০১২ / রাইফেল নিয়ে ইউনিফর্ম পরিহিত রাষ্ট্রীয় সৈন্য), বিদ্রোহীদের সাফল্য (২০১৩ / স্টেনগানসহ মাথায় ফেট্টি-বাঁধা এক বিদ্রোহী তরুণ), অবশেষে বিদ্রোহের ফলশ্রুতিতে ইসলামিক রাষ্ট্রের উত্থান (২০১৪ / কালো আলখাল্লা পরিহিত ও অত্যাধুনিক রাইফেল নিয়ে মুখোশ পরিহিত ইসলামিক জে হাদি)।
সিরিয়ান ব্যাঙ্কসির ট্যাগ দিয়ে আমেরিকার ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’-র ঢঙে একটি নব্য-আরবীয় ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’-র সঙ্গে শিল্পীর বয়ান―‘স্বাধীনতা আজ আর মূর্তিমাত্র নন, তিনি রক্তে-মাংসে জীবন্ত।’
শুধু আবু মালিক আল-শামি নন, যুদ্ধবিধ্বস্ত, রাজনীতি-বিভ্রান্ত, আশাভঙ্গের বেদনায় অবনত সিরিয়ায় অনেক দেয়াল ও রাস্তার শিল্পী রাজধানী দামাস্কাস এবং আক্রান্ত শহরগুলির দেয়ালে, সিরিয়া-তুরস্কের বর্ডার ওয়ালে প্রচুর গ্রাফিতির জন্ম দিয়েছেন। এই শিল্পীদের মধ্যে তাম্মাম আজ়ম, আজ়িজ় আল এসমার (আসমার?), সালাম হামিদ, মুহম্মদ এনিস, ৩৩৬ আজ়িজ়, শেরিন আবু আগলে (?) বেশ পরিচিতি লাভ করেছেন। সিরিয়ান গ্রাফিতিতে স্বাধীন প্যালেস্টাইনের সমর্থনে গণনীয়-সংখ্যক গ্রাফিতির দেখা মেলে। গ্রাফিতির দেয়ালে লেখা থাকে কয়েক মিলিয়ন উদ্বাস্তুর বেদনার কথা (যাদের মধ্যে মাত্র ০.৩৮ ইউরোপে পুনর্বাসন পান), গ্রাফিতি শিল্পী স্বপ্ন দেখেন বড়ো শক্তিগুলি সযত্ন প্রযত্নে (অ স্ত্র দিয়ে, অর্থ দিয়ে, পরামর্শ দিয়ে এবং হস্তক্ষেপ করে) উৎখাত করা বাশার আল-আসাদ আবার ফিরে আসছেন এবং উদ্বাস্তুরা আবার দেশে ফিরে স্বপ্রতিষ্ঠ হবার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু এসব কিছুই হয় না, এপ্রিল ফুলের মতো তা রসিকতায় পর্যবসিত হয়। সিরিয়ার গ্রাফিতি শিল্পীরা ফুটবলের জাদুকর ও আদ্যন্ত বামপন্থী আর্জেন্টিনার দিয়েগো মারাদোনাকে দেয়ালে দেয়ালে অন্তরের ও তুলির প্রাতিকৃতিক শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন।"
......................................................
আসছে...
কলকাতা বইমেলা অথবা বইমেলার আগেই...
.
.
.
দেয়ালের লেখা : এক অন্তহীন প্রকীর্ণ শিল্পকথা
অনন্ত জানা
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment