নির্মুখোশ শারদ ১৪৩২।। সার্কাসের ইতিকথা।। বরুণদেব।।

১৮৭৯ সালে চিয়ারিনির রয়‍্যাল ইটালিয়ান সার্কাসের তাঁবু পড়ল বোম্বের বোরিবন্দর রেলস্টেশনের কাছে ক্রস ময়দানে। এই বোরিবন্দর রেলস্টেশন থেকেই ছাব্বিশ বছর আগে ভারতীয় রেল শুরু করেছিল তার যাত্রা। ১২ই ডিসেম্বর, ১৮৭৯-তে চিয়ারিনির প্রদর্শনীর উদ্বোধন করলেন বোম্বে প্রদেশের গভর্নর রিচার্ড টেম্পল। এর কয়েকদিন পর ক্রিসমাসের রাতে দর্শকপূর্ণ তাঁবুতে চিয়ারিনি ছুঁড়ে দিলেন চ্যালেঞ্জ—

আমি জানি, ভারতে কোনো সার্কাস দল নেই। আরও অনেক বছর ভারতকে অপেক্ষা করতে হবে নিজেদের সার্কাসের জন্য। চ্যালেঞ্জ করছি, যদি কেউ আমার মতো ঘোড়ার খেলা দেখাতে পারে, তাকে আমি ভারতীয় মুদ্রায় এক হাজার টাকা দেব। সেই সঙ্গে আমার প্রশিক্ষিত ঘোড়াগুলোর মধ্যে যে কোনো একটা ঘোড়া দিয়ে দেব। ছ'মাস সময় দিচ্ছি। আছেন কেউ? কেউ আছেন? থাকলে এগিয়ে আসুন।

এই বিস্ময়কর ইউরোপীয় শিল্পের সম্মোহন প্রত্যক্ষ করতে সার্কাসের তাঁবুতে সে সন্ধ্যায় হাজির দেশীয় রাজারা, সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। দর্শকাসনে সপারিষদ উপস্থিত মহারাষ্ট্রের কুরুন্দওয়াদ প্রদেশের রাজা বালাসাহেব। আর ছিলেন অশ্বারোহী বিষ্ণুপন্থ মোরেশ্বর ছত্রে, কুরুন্দওয়াদ রাজপ্রাসাদের আস্তাবলের সুপারিনটেনডেন্ট।

ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি থেকে রানি ভিক্টোরিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তরের পথে সিপাহী বিদ্রোহত্তর ভারতের শরীর চর্চার সংস্কৃতিতে তখন বিভিন্ন প্রাদেশিক মার্শাল আর্ট আর পথেঘাটে মাদারি কা খেল। সে শরীরচর্চার ভারতীয় প্রদর্শনীতে রাজন্যবর্গের হাততালি ও উপহারের ডালি জুটলেও, না ছিল সার্কাসীয় পরিকাঠামো, না ছিল সে উদ্যোগ। সার্কাসের মতো সংগঠিত শিল্পের পরিসর গড়ে ওঠে নি তখনও। বোরিবন্দরের ক্রিসমাস রাতের সার্কাসের রিঙে চিয়ারিনির চ্যালেঞ্জ ও তাঁর অশ্বারোহনের নানা কসরতের সেই মায়াবী কয়েক ঘণ্টা ভারতীয় সার্কাসের সম্ভাবনার বীজ বুনে দিয়েছিল মননে, যার অঙ্কুরোদগম হয়েছিল সেদিন দর্শকাসনে বসে থাকা বিষ্ণুপন্থ ছত্রের হাতে। সময়ের চলমানতায় সে চারাগাছ ক্রমশঃ বৃক্ষে পরিণত হয়েছে, ছায়া দিয়েছে, ভরসা জুগিয়েছে। ভারতের প্রান্তিক জনজীবনকে দিয়েছে আশ্রয়, জীবনধারণের রসদ।

চিয়ারিনির চ্যালেঞ্জ, ভারতীয়দের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া সেই অবজ্ঞার শব্দগুলো, বিদ্ধ করল কুরুন্দওয়াদের রাজা বালাসাহেবকে। বন্ধু টিল্লুকে বললেন, ছত্রে এই সাদাটার চ্যালেঞ্জ নিতে পারে না? ছত্রে বললেন— আগে দেখি, তারপর প্রত্যুত্তর। ছত্রে চ্যালেঞ্জটা নিলেন— 

মহারাজ বালাসাহেবের সম্মতিক্রমে আপনার চ্যালেঞ্জ আমি গ্রহণ করলাম। আপনার দেওয়া ৬ মাস নয়, তিন মাসের মধ্যেই আমি আমার ঘোড়াগুলিকে নিয়ে আপনার মতোই খেলা দেখাতে পারব। আর যদি না পারি, তবে প্রতিজ্ঞা করছি, ব্রিটিশ-ভারতীয় মুদ্রায় দশ হাজার টাকা আপনাকে দেব, সঙ্গে দশটা ভালো জাতের ঘোড়া। আপনি বললেন বছরের পর বছর লেগে যাবে ভারতের মাটিতে ভারতীয় সার্কাসের জন্ম হতে, আমি বাজি ধরছি, এক বছরের মধ্যেই আমি ভারতীয় সার্কাসদল তৈরী করব আর সে দল নিয়ে যাবও আপনার দেশে।

তাঁবুর ভারতীয় দর্শকরা উল্লাসে ফেটে পড়ল। রাগে লাল হয়ে গেলেন চিয়ারিনি এক নেটিভের ঔদ্ধত্য দেখে।
.................................................
সার্কাসের ইতিকথা
বরুণদেব
................................................
নির্মুখোশ শারদ ১৪৩২

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী 
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত

মুদ্রিত মূল্য : ২৫০ টাকা

আসছে.....

Comments

Popular posts from this blog

চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে।। অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

এক যে ছিল গ্রাম।। অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। সুপ্রকাশ।।

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।