নৈশ অপেরা।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।।
সেদিন রাত্রে অতিথিরা বিদায় নিলে আমি পোড়ো মাঠের দিকে মুখ রেখে জেগে ছিলাম অনেকটা সময়। আমার হাতে ধরা ছিল একটা বাইবেল। শীতের রাত্রে জমাট মেঘ অবসাদের মতো ঘনিয়ে এসেছিল। মশাদের কোরাস বাড়িটাকে নিঃসঙ্গতায় ফাঁপিয়ে তুলছিল। কে দাঁড়িয়ে ছিল জলাভূমির ওপাশে? হাওয়ার গুঞ্জন বাদে অন্য কিছু কানে আসেনি। এখানে আসার পর থেকে রোদের তাপ কমে গিয়েছিল। শান্ত গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ফিসফিস আমার চারপাশ ভরিয়ে তুলেছিল অবোধ্য গুঞ্জনে। তাদের আমি কান পেতে শুনতে চেয়েছিলাম। সত্যিই কি আমি এগোব? আমার কী লাভ এতে? আমি তো গোয়েন্দা নই। এসেছি নিছক ঘুরতে। একটা অ্যাবসার্ড রহস্য, অবিনাশ যাদব যেমন বলে গেলেন, আমাদের অস্তিত্বের প্রতিটা পূর্বশর্তকে যা হা-হা স্বরে উড়িয়ে দেয়, তার পেছনে ছুটে কী লাভ? কেন আমরা সবাই ইতিহাসে বাঁচব? সময়, যে যতই বলুক, কোনো চ্যাপটা বৃত্ত নয় যার ভেতর ঘুরে ঘুরে আমাদের সেই কাজ, একই কাজ এবং আবার ও বার বার একই কাজ করে যেতে হবে। ক্রিস ব্রাউন হারিয়ে গিয়েছে চিরতরে। তার রহস্যের সমাধান হয়নি। ফলত, এতদিন পরে কেন নাড়াঘাঁটা করব তাকে? আমি একজন পোড়খাওয়া ইনভেস্টিগেটিভ সাংবাদিক। আমার কী এসে যায় বহু বছর আগের এক ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নিয়ে? হাতে ধরা বাইবেলের পাতা উলটিয়ে আমার চোখে তখন ঘুম ঝাঁপিয়ে নেমেছিল। দেখেছিলাম, আমি শুয়ে আছি নিজের সল্টলেকের বাড়ির সোফায়। অকেজো একটা ফ্রিজ আমার মাথার পেছনে বসানো। তার ভেতর থেকে ফিসফিস ভেসে আসছিল। ফ্রিজের পেছন থেকে শুরু হয়েছে একটা জঙ্গল, যার পেটের ভেতর গোলকধাঁধা। আমার মাথার কাছে পায়ের শব্দ। তবু কাউকে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। চাপাস্বরে আনাগোনা করছিল। শোক। ক্রমে দুর্ভেদ্য কুয়াশায় ঢেকে গেল জলা ও জঙ্গল। মুখ ফিরিয়ে দেখলাম, জঙ্গলে ঢাকা আমাদের ঘর দরজাবন্ধ। সোফা থেকে উঠে ঘরের দিকে আমি হেঁটে যাচ্ছি। ধুলো জমা টেবিল পেরিয়ে, দেওয়ালের ছবিতে শুকনো ফুলের মালা অতিক্রম করে, বেডরুমের বন্ধ দরজায় ধাক্কা মারছি। কান পেতে শুনছি ভেতরের নৈঃশব্দ্য তীব্র চিৎকারে দীর্ণ হচ্ছে। আমি তখন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকছি। বিছানায় শুয়ে এক কিশোরী। অন্ধকার ঘর হলেও তার চোখে রোদচশমা, পরনে ফুলছাপ ড্রেস। কিন্তু, তার গলায় ফাঁস। যেন ঘাড়ভাঙা পুতুল। আমি হাত বাড়িয়ে তাকে ধরতে যাচ্ছি আর দেখছি আমার গায়ে উঠে এসেছে ফুলস্লিভ সোয়েটার, তার হাতায় সাদা ময়ূরের ডিজাইন। তবু তাকে ছুঁতে পারছি না আমি।
যখন ভোরের আলো গাছের পাতা বেয়ে চুঁইয়ে পড়ল এবং অরণ্যের অপরপ্রান্ত থেকে জেদি মোরগের কঁক ধ্বনি ভেসে এল, তখন আমি চোখ মেললাম। আমার মনে হল রাত্রির কাফন সরিয়ে আমি শেষবারের মতো পৃথিবীকে দেখব, যদিও তা অসম্ভব, কারণ অনেক আগে ওরা আমাকে মেরে ফেলেছে, মনে হল আমার। আমি বুঝলাম, বারবারা না-ডাকলেও গতকাল আমি সন্ধেবেলা নীচে যেতাম। কারণ, একটা অমীমাংসিত গল্পকে শেষ করার দায় থেকে আপাতত আমার মুক্তি নেই।
.
.
.
নৈশ অপেরা
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
মুদ্রিত মূল্য : ৫৪০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment