নৈশ অপেরা।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া
সুপ্রকাশ প্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের উপন্যাস 'নৈশ অপেরা' পড়ে মতামত জানিয়েছেন নীরা মুখার্জি। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
....................................................
"লীন হয়ে গেলে তারা তখন তো - মৃত।
মৃতেরা এ—পৃথিবীতে ফেরে না কখনো।
মৃতেরা কোথাও নেই; আছে?"
- জীবনানন্দ দাশ
একটা মৃত গঞ্জ. যেখানে বাস করা প্রতিটা মানুষই মৃত. তারা কেবল বেঁচে থাকে ছায়ায়. সময় এখানে ক্লান্ত আর অন্ধকার নিস্পন্দ. শুধু অতীতের কঙ্কালরা কুয়াশার গায়ে মাখিয়ে রাখে ভুলে যাওয়া ইতিহাস ও স্মৃতিদের. গঞ্জে বেড়াতে আসা ক্রাইম রিপোর্টার তনয়া হঠাৎই সম্পৃক্ত হয়ে যায় এই ইতিহাসের সঙ্গে. গঞ্জের ডেভিড ব্রাউনের বাড়ী থেকে অতীতে হারিয়ে গিয়েছিল এক শিশু. ক্রিস. ক্রিসের অন্তর্ধান রহস্যের মাঝেই সামনে এসে দাঁড়ায় আরো এক চরিত্রের কাহিনী - যাকে এই গঞ্জ ভুলে গেছে অথবা ভুলে যেতে চেয়েছে. সে হলো অ্যাগনেস ও'ব্রায়েন. অন্তর্ধান হয়েছিল সেও ক্রিস কাহিনীর পাঁচ বছর আগে. কিন্তু স্মৃতির আনুগত্যে লুকিয়ে থাকা বিস্ময় আর প্রশ্নেরা সব সময়ই শক্তিশালী. তাই, অ্যাগনেস মুছে গিয়েও গঞ্জের স্মৃতিতে জড়িয়ে থাকে আর কুরে কুরে খায় জীবন. আর এখান থেকেই সত্য অনুসন্ধানের যাত্রা প্রাগৈতিহাসিক ভয়াবহতাকে খুঁড়ে আনে আর সাজিয়ে তোলে "নৈশ অপেরা" কে এক করুন, বিষাদঘন, মর্মান্তিক ও মেলাংকলিক শোভাযাত্রায়।
এই রহস্য কাহিনী আমার পড়া অন্যান্য রহস্য কাহিনীর থেকে অনেকটাই আলাদা, কারণ; এখানে বাকি চরিত্রদের মত "গঞ্জ" ও হয়ে উঠেছে একটি চরিত্র. একটি স্মৃতির শরীর. তাই, গঞ্জের বিবরণ, তার নিস্তরঙ্গতা, একাকী শূন্যতা - সব কিছুই সবার প্রথমে এক ভারী নিথর নৈঃশব্দে জড়িয়ে ধরে এবং মানসিক ভাবে প্রস্তুত করায় এই কাহিনীর যাত্রী হতে.
পর্বতপ্রান্তর, মৃত্তিকায় অঙ্কিত মহাদেশের জন্মচিহ্ন, গভীর উপত্যকা—এসবের অন্তঃস্থলে আজও গোপনে প্রবাহিত হয় প্রাগৈতিহাসিক কিছু সত্য যা নিপুণভাবে লুকানো। যা ভেদ করে উঠে আসে অন্ধকারের স্তব্ধ ঢেউ, যেখানে বদ্ধ থাকে স্মৃতির টালমাটাল দোলাচল, জনমানসের গোপন স্পন্দন, শৈশবের ক্ষত, আর অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের জটিল দ্বন্দ্ব। "নৈশ অপেরা"- কে লেখক এমনই আবহে পূর্ণ করেছেন.
শাক্যজিত ভট্টাচার্যের লেখনীর সাথে এই আমার প্রথম পরিচয়. ওনার লেখা এতটাই শক্তিশালী ও বাঙ্ময় - যার নির্মোহ অভিঘাত নেমে আসে দ্রুত আর স্তব্ধ করে দেয় অনেকটা সময়ের জন্য.
এই কাহিনীর আরো এক অসামান্য চরিত্র হলো, "সময়". কারণ, সময় এখানে তার মধ্যে ভরে রাখে আরো অনেক কটা সময়কে. কিন্তু এই সময়ের গহ্বর এতটাই গভীর হয় যে, এতটাই স্থির হয় যে, অতীত দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গায়, অনন্ত পুর্ন জন্মের মতো।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে বোধহয় এমন কোনো সময় ছিল না, যখন সবল দুর্বলকে শোষণ করেনি, তার শ্বাসরোধ করেনি। সেই একই পুনরাবৃত্তি ঘটে এখানে। তনয়া যখন ভগ্ন সূত্রগুলো জুড়ে সত্যের সুতোয় টান দেয়, প্রশ্ন করে, অ্যাগনেস কে? আর্থার কে? কে এই মানবশিশু? ক্রিসের সঙ্গে তাদের কি সম্পর্ক? কেন তাদের মৃত নিঃশ্বাস বুকে চেপে অদ্ভুত ঘুমে জেগে আছে এই গঞ্জ?
তখন সামনে আসে এক নির্মম দৃশ্যপট—অনাড়ম্বর অথচ বিধ্বংসী এক শোকের অভিঘাত।
অ্যাগ্নেসের জন্য যতবারই বেদনা অনুভূত হয়, ততবারই এই কাহিনীর আঘাত একটু একটু করে আমার হৃদয়ে জন্ম দেয় এক করুন সঙ্গীতের, যার সুর বাঁধা থাকে "নৈশ অপেরা" র ভুলে যাওয়া পাপ, ক্ষয় ও শোকের মূর্ছনায়. যা নিঃশেষে মুছে দিয়েছিল অ্যাগনেস কে, ষোলো বছরের অ্যাগনেস কে,
আর তাই, এই বই আমার কাছে কেবল একটি রহস্যকাহিনী নয়। এটি এক শোকসংগীত, এক রাতের অপেরা, যেখানে প্রতিটি সুর, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি নৈঃশব্দ জড়িয়ে আছে মৃত্যু, স্মৃতি আর মানবহৃদয়ের অপূরণীয় বেদনার সঙ্গে।
বই : নৈশ অপেরা
লেখক : শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য
প্রকাশনা : সুপ্রকাশ
মূল্য : ৫৪০ (মুদ্রিত)
Comments
Post a Comment