অনন্যবর্তী।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।


সুপ্রকাশ প্রকাশিত দুর্লভ সূত্রধরের উপন্যাস 'অনন্যবর্তী' পড়ে গুডরিডস্-এ মতামত জানিয়েছেন ফরজানা রহমান। আমরা নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
.........................................................
বই : অনন্যবর্তী
লেখক : দুর্লভ সূত্রধর
প্রকাশক : সুপ্রকাশ
পৃষ্ঠা : ২৩৬
মূল্য : ৩২০ রুপি

ইউটোপিয়ান ঘরনার গল্প দুর্লভ সূত্রধর-এর "অনন্যবর্তী"। আমাদের জীবন অবশ্যই সেই ঘরনার নয়। আমাদের স্বপ্নে অবশ্য আমরা ইউটোপিয়ান কিছুর চারপাশে কুয়াশা মাখা কিছুর কংকাল দেখি। বেগুনি পেরেকে বিদ্ধ এই জীবনের জটিলতার উত্তাপে স্বপ্নে ঘনত্ব ধীরে ধীরে কমতে থাকে। বিশেষ কিছু কথা উৎসাহ নিয়েই ঘুম আসে। আবার ঘুম শেষে হারিয়ে যায় স্বপ্নটা নিজের ছায়ার মতো। আদতে আমরা কি খুব সাধারন একটা গল্পের কাছে সমর্পিত হই? আমাদের পড়া গল্পের প্লটটাও যেন জটিল হতে হয়। খুব সাধারন একটা হাওয়াই মিঠাই টাইপ গল্প তারপরও আমাদের সমর্পিত হতে বাধ্য করে।

দুর্লভ সূত্রধর-এর "অনন্যবর্তী" সেই গোলাপি হাওয়াই মিঠাই। নান্দনিক। উপন্যাসটি গভীর নয়, আবার গভীর জীবনবোধের অভাবে দুষ্ট নয়। হালকা, তবে ওজনহীন নয়।

'অনন্যবর্তী' অনেকটা আমাদের সেই ফেলে আসা দুপুর আর বিকেলের মাঝামাঝি সময়ের শ্যাওলা জমা বিশেষত্বহীন ছাদে মৃদু হাওয়ায় দোলা মায়ের শুকনো শাড়ি। স্মৃতির দিকে গেলে শুধুই শাড়ি জুড়ে ভাতের মাড়ের ঘ্রাণ। স্বপ্নের দিকে গেলেও ভাতের মাড়ের ঘ্রাণ। অনন্যবর্তী সেই ভাতের মাড়ের ঘ্রাণ। সহজ, সরল ও সুন্দর।

দুর্লভ সূত্রধর-এর "অনন্যবর্তী" একদল ছেলে-মেয়ের গল্প। পাশাপাশি জীবনের শেষ অধ্যায়ে পা রাখা একদল বড়দের গল্পও। জীবনের জটিলতায় যেখানে সাধারনত এমন সেট-আপ-এ জেনারেশন গ্যাপ আর তার সংঘাতটুকু প্রকট হয়ে ওঠে— অনন্যবর্তী সে চেনা ছকে হাঁটেনি। বরং প্রশান্তিময় এক বোঝাপোড়ায় এগিয়েছে গল্প ও এর সকল চরিত্ররা। তাই এই সকল চরিত্রগুলোর সাথেই পাঠকের বোঝাপড়া। পাঠকের ভাবনার উপজীব্য।

অনন্যবর্তী-র চরিত্রগুলো আহামরি কোন জৌলুসের পোষাকে আবৃত নয়। একদম সাদামাটাও নয়। মায়োপিক চোখে (বা মনে) দেখলে ফার্নেসে জমা জলের মতো। মিনিয়েচার মৌচাকের ঝাঁক। অথচ কোথাও যেন তাদের ছায়া অনবরত মিশে যাচ্ছে আমার সাথেই। পরিপ্রেক্ষিত জমিনে ঠায় দাঁড়িয়ে তাই শোভন, তনয়, টুকু, তরণী, কাজু, সতীশচন্দ্র, শচীপ্রসাদ, ফণিভূষণ হয়ে ওঠে চেতনার নিয়ন্ত্রক। আয়নায় মুখ দেখা।

একদম সহজ, সরল, জটিলটা বিবর্জিত ন্যারেশনটা কেন তাহেলে হয়ে ওঠে মনোগ্রাহী ও হৃদয়গ্রাহী? "যাদের জীবনে কোন ম্যজিক নেই" এই গল্প হয়ত তাদের। এই গল্প তাই আমাদেরও, যাদের ম্যজিক নেই, হয়ত প্রত্যাশা আছে। যে প্রত্যাশার বিপরীতে মানিয়ে নিতে হয়— "বেশি কিছু চাইবি নে। একটা মাত্র লোকই উত্তমকুমার হয়।" ঠিক সেখানে এসেই "অনন্যবর্তী" হয়ে ওঠে পাঠকের স্যানাটোরিয়াম।

কাহিনির শুরুতে শোভনের উড়োজাহাজ আর শেষটায় শটিগ্রামের স্বপ্নের খামার— নিচে বয়ে যাওয়া কুন্তী নদী— এমন মিঠে একটি আবহে গল্পের চরিত্রগুলোর সাথে বসে আমি যা দেখি তার নাম জারমিনেশন। স্বপ্নের, আকাঙ্খার, প্রত্যাশার এবং আবেগের। মনে হয়, জটিল এই জীবনটা সূত্রধর-এর "অনন্যবর্তী" এর মত দুর্লভ না হোক; ফিরে আসুক মাড় দেয়া শাড়ীর অলস ছাঁদ। আমাদের অভিযোগগুলোও যেন আমাদের চেনাজানা হোক।

দুর্লভ সূত্রধর-এর "অনন্যবর্তী" আমাদের আয়নার সামনে দাড়িয়ে চেনা প্রতিচ্ছবি হোক। দুর্লভ না হয়ে থাকুক। 'অনন্যবর্তী' পাঠকের কাছেও দুর্লভ না থেকে হয়ে উঠুক তাদের স্যানাটোরিয়াম। দুর্লভ সূত্রধর এবং সুপ্রকাশ এ আস্থা ছিল, এবং হতাশও করেনি।

ম্যজিকহীন জীবনে "অনন্যবর্তী" যেন ম্যাজিক হয়েই মিশে থাকে।

Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম।। অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। সুপ্রকাশ।।

চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে।। অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।