নির্মুখোশ শারদ ১৪৩২।। সীমান্ত রেখা।। অবিন সেন।। সুপ্রকাশ

চারপাশে অন্ধকারটা ঝাঁপিয়ে নেমেছে। এমন অন্ধকারের একটা গন্ধ আছে, যেন ভেজা ভেজা ঝোপঝাড়ের গন্ধ। কানু শুধু গন্ধটা পায়। সারা রাস্তাটায় এখন ইলেকট্রিক পোস্টে পোস্টে আলো লাগানো হয়েছে। কিন্তু অবনীদের বাড়ি পেরিয়ে চুলের কাঁটার মতো এই বাঁকানো মোড়ের কাছে দু তিনটে পোস্টের আলো কারা যেন ভেঙে দিয়ে যায় নিয়মিত। কানুর সাইকেলের আলোটা আবার খারাপ হয়ে গিয়েছে। নিকষ অন্ধকারে ঢুকে পড়ে ভিজে ভিজে গন্ধটা ছ্যাঁত করে তার নাকে লাগে। বুকের ভিতরে একটা ঢিব ঢিব শব্দ শুনতে পায় সে। কানুর হাত-পায়ের পেশী শক্ত আর কঠিন হয়ে ওঠে। কোথা থেকে একটা অলৌকিক শক্তি যেন তার দেহের ভিতরে ভর করে। সাঁ সাঁ করে প্যাডেল ঘুরিয়ে সে অন্ধকারটা পেরিয়ে যায়। আরও প্রায় দু তিন কিলোমিটার তাকে সাইকেল চালিয়ে যেতে হবে। রাস্তাটা এবার ফাঁকা মাঠের মধ্যদিয়ে। চারপাশে বাড়ি ঘর নেই। দু পাশে লম্বা লম্বা গাছের সারি। আধুনিক নব্য সভ্যতা যেন এই পর্যন্ত এসে থেমে গিয়েছে। এর পর থেকে প্রকৃতি যেন আপন খেয়ালে নিজেকে নিয়ে গড়েছে, ভেঙেছে আর মুচকি হেসে মানুষের যাবতীয় আধুনিক সভ্যতার হিসেব নিকেশকে ওলটপালট করে দিয়েছে। এই রাস্তাটা পার হতে কানুর বেশ ভয় ভয় করে। কিসের ভয় কানু ঠিক জানে না। তবে অদৃশ্য একটা কিছুর কল্পিত ভয় তার বুকের ভিতরটাকে ভারি করে রাখে। সে জানে, মানুষের সব থেকে ভয় মানুষ যা দেখতে পায় না তা নিয়ে। কিন্তু তবু যেন তার মনে হয় কিছু একটা অমঙ্গল যেন ঘটে যাবে কোনও দিন। সুদূর কোনও এক দিনের কোনও এক অমঙ্গলের ধারনায় সে ভীত আর ম্রিয়মাণ হয়ে থাকে। সেই সঙ্গে শরীরের ভিতরে দ্রুত সাইকেল চালাবার উদগ্র ত্বরা তাকে বাসনাব্যস্ত করে রাখে। বনবন, বনবন করে সে সাইকেলের প্যাডেল ঘোরাতে থাকে। মনে মনে বলে আর একটু, আর একটু তো পথ, ওই তো সামনে দেখা যাচ্ছে তাদের গড়। পূর্ণবাবার গড়। গাছপালা ঘেরা আধো অন্ধকারের গড়।

এই পথটুকু নির্জন জনমানবহীন, শুধু রাতচরা দু-একটা পাখির ডাক মাঝে মাঝে কোথা থেকে ভেসে এসে নীরবতার ধ্যানভঙ্গ করে যায়। হাওয়ার বেগে কানু সাইকেল চালায়। হেমন্তের শেষে ঠাণ্ডা পড়েনি এখনো, তবু বাতাসের রোঁয়ার ভিতরে একটা শীতের আমেজ লুকিয়ে আছে, রাত নামলে সেই আমেজ তার আলতো নখ বার করে একটু আঁচড়ে দেয়। গায়ে কাঁপন ধরে। তার কানের ভিতরে হাওয়ার দমক ঢুকে পড়ে তেমনি একটা কাঁপন ধরাচ্ছিল গায়ে। এই ঠাণ্ডার বোধের ভিতরেও তার হাতের তালু ভিজে উঠেছে যেন হিমেল বাতাসের সঙ্গে কিছুটা ঠাট্টার অছিলায়। সে সাইকেলের হাতলের উপরে তার মুঠিটা বার বার ঘোরাতে থাকে, যেন অজান্তেই সে তার হাওয়া গাড়ির গতি বাড়িয়ে নিচ্ছে। এই রাস্তাটা সে চোখ বন্ধ করেও চালাতে পারে। রাস্তার প্রতিটা ধুলোবালি তার চেনা। চেনা চেনা প্রতিটা গাছ, লতা পাতা, গুল্ম। অথচ একদিন কি তার চেনা ছিল এই সব! কেমন একটা অন্ধকার জলের স্রোতে সে তলিয়ে যাচ্ছিল। নৈশব্দে। কে তাকে কুড়িয়ে নিয়ে এলো? ভাবলে কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে হয় তার। সে জানে যখন সে গড়ে পৌঁছাবে তখন রাত প্রায় এগারোটা বেজে যাবে। এতো রাতে তাদের গড়ে কেউ জেগে থাকে না। জেগে থাকবার কোনও প্রয়োজন পড়ে না কারও। শুধু সে জানে একটা ঘরের জানালায় তখনো আলো দেখা যাবে। শেষ হেমন্তের হিমেল বাতাসকে অগ্রাহ্য করে একটা জানালা তখনো খোলা থাকবে। কাচের ডোম ঘেরা ক্ষুদ্র একটা লণ্ঠনের শীর্ণ শিখা সে দেখতে পাবে। ওইটুকু শিখা কি তাকে ঘরে ফেরবার প্রবল আকর্ষণে আবদ্ধ করে রেখেছে? কি এক দুর্নিবার আকর্ষণ সেই শিখার। না হলে তার শরীরের পেশীতে পেশীতে এতো কিসের উদগ্র খল খল হাসি। তাকে কেবল ব্যস্ত আর অক্লান্ত করে রাখে!

দুরন্ত বেগে প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে সে চোখ বুজে ফেলে। এক বার। বার বার। চোখ বুজলেই তার চোখের সামনে একটা ছবি বার বার ভেসে ওঠে। চালতা-পুকুরের নিটোল জলের মতো অন্তরঙ্গ আর শান্ত একটা ছবি। দুপুরের শিয়রের কাছে কেমন মাথা পেতে শুয়ে থাকে। কানুরও ইচ্ছা করে শুধু সেই ছবিটার কাছে মাথা পেতে শুয়ে থাকবে সে। ছবিটার কাছে শুয়ে শুয়ে সে ঠিক একদিন মরে যাবে। মরে গেলেও তার কোনও দুঃখ হবে না। সে জানে। শুধু মাঝে মাঝে অলীক রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মনে পড়ে, কোনও একদিন যদি সে সেই ছবির ভিতরে গিয়ে বসতে পারত। একদিন ছবির একটা চরিত্র হয়ে গিয়ে ইজেলে লগ্ন হয়ে থাকতে পারত! তার পরেই তার ঘুম ভেঙে যায়। বুকের ভিতরে তখনই একটা কাচ ভেঙে যাবার ঝন ঝন শব্দ শুনতে পায়। একটা লণ্ঠন ভেঙে কাচ ছড়িয়ে পড়ল যেন। লণ্ঠনের শিখাটা নিভে গিয়েছে হাওয়ায়। ঘোর অন্ধকার। চার পাশে ভাঙা কাচের ধারালো নখ। সে কোথাও পা বাড়াতে পারে না। নিঝুম অন্ধকারের ভিতরে সে দাঁড়িয়ে থাকে। তবু কি কোনও একদিন সে পা বাড়াবে? ক্ষত বিক্ষত হয়ে রক্তাক্ত হবে জেনেও!
.................................................
সীমান্ত রেখা
অবিন সেন
................................................
নির্মুখোশ শারদ ১৪৩২

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী 
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত

মুদ্রিত মূল্য : ২৫০ টাকা

আসছে.....
      

Comments

Popular posts from this blog

চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে।। অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

এক যে ছিল গ্রাম।। অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। সুপ্রকাশ।।

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।