নৈশ অপেরা।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ
আমি স্যাংচুয়ারিতে থেকে গিয়েছিলাম, দশদিন ছাড়িয়ে আরও পাঁচদিন। বাড়িটাকে তামার পয়সা ঘষা কাচের মতো অস্বচ্ছ মনে হত আমার। বাড়ির ডান দিকের ভগ্নস্তূপে চোখ চালালে ঘর, স্টোররুম, গাড়িবারান্দার অনুপস্থিত ছায়া। বামদিকের যে অক্ষত অংশে আমরা ছিলাম, তার বন্ধ ঘরগুলোর দরজায় কান পাতলে নৈঃশব্দ্যকে অন্তর্ভেদী ও হাহাকারময় লাগতে পারত। সস্তা পর্দার দল প্রবল হাওয়ায় ওড়াউড়ি করত। বাড়ির পেছনে পাঁচিল ভেঙে পড়েছে। তার ওপাশে নাকি কোনো একসময়ে একটা জঙ্গল ছিল, একশো বছর আগে পুড়ে যায়। এখন একটা আগাছা ভরতি দিগন্তবিস্তৃত বিরাট মাঠের আকার নিয়েছে যার বেশিরভাগ অংশ জুড়ে গভীর কাদা, জলাভূমি, বুকসমান বুনোঘাসের সারি। একটা অ্যাম্বাসাডর গাড়ির কঙ্কাল জলার অপরপ্রান্তে বসে আছে। মাঠ ও জলার ভেতর ইতিউতি মাথা উঁচু করে থাকে গাছের গুঁড়ি, আমগাছের হাত মেলা কঙ্কাল। অঞ্চলটা আকারে এতই বিশাল ও স্থানে স্থানে অগম্য যে, তার অপরপ্রান্তের জঙ্গলকে আকারে বামন লাগে, শালগাছকে মনে হয় কোমরসমান। স্যাংচুয়ারির অক্ষত অংশের মাথায় টালি। সেখান দিয়ে বুনো লতা নেমেছে। বাড়ির সামনে, পেছনে অনেকটা জায়গা ঘিরে বাগান। সেখানে যত্নের অভাবে আগাছা। শিশু কোলে মেরির ছোট্ট মন্দির, মুরগির ঘর। জায়গাটা টাউনের বাইরে। এখান থেকে লাতেহার ফরেস্টের একটা অংশ শুরু হচ্ছে। কিছুটা এগোলে চামা। আশেপাশে অনেক পোড়ো কটেজ। মহুয়াটাঁড়ের জঙ্গল তাদের অধিকার করতে এগিয়ে আসছে। কয়েকটা কটেজ ভাঙাভাঙি হচ্ছে। দূরবর্তী নাট্টা পাহাড়কে এখান থেকে দেখা যায় না। পরিবর্তে ধু-ধু বিকেল জুড়ে সারাদিন পাতা ঝরে। ডেগাডেগি নদীর বুক থেকে উঠে আসা হিমাভ ভাপ জায়গাটাকে অধিকার করে। বাড়ির সামনের শিশিরভেজানো পাহাড়ি পথ ধুলোয় ঢাকা। প্রতি সন্ধেবেলা গম্ভীর মোষের সারিকে সেই পথ দিয়ে ঘরে নিয়ে যায় এক আদিবাসী ছেলে। পশুদের খুরের আঘাতে ধুলোময় সূর্যাস্ত দেখে আমার মনে হয় তাদের এই মেলাংকলিক যাত্রার গন্তব্য বুঝি কোনো সমাধিস্থলই হবে। দিগন্ত থেকে মাঠ পেরিয়ে একলা আগন্তুককে হেঁটে আসতে দেখি— তার ডান পাশে ভেড়ার সারি, বামপাশে ছাগল। তারপর সে কুয়াশায় ঢেকে যায়। বাড়িতে আমি বাদে টুরিস্ট নেই। বাকি ঘরগুলো ভেজানো থাকে। বারবারা বকবক করে তার রাঁধুনি পুনমের সঙ্গে, আমি দোতলা থেকে শুনতে পাই। কুকুরেরা বেড়া টপকে বাগানে ঢুকে পড়লেও কেউ কিছু বলে না। আমার ঘরে দুটো জানালা ছিল। পেছনেরটা খুলত জলাভূমির দিকে, আর ব্যালকনির দিকের জানালা দিয়ে চোখে পড়ত টুকটাক খেতভূমি, ঝাঁটিফুলের ঝোপ। সেখানে নির্ভয়ে বহুরঙা পাখিরা উড়ে আসে। প্রৌঢ় হেমন্তের থকথকে কুয়াশা দৃষ্টিকে দূরে যেতে দেয় না অনেকটা বেলা পর্যন্ত। ভোরবেলা ব্যালকনিতে কফির কাপ নিয়ে বসলে ঝিম আর্দ্রতা আচ্ছন্ন করে আমার শরীরকে। মনে হয়, অনেক মদের সম্ভার অবিরল প্রকৃতির ঢালে, যারা সুপ্ত ও ইশারাপ্রবণ, আমার ইনসমনিয়ার ত্বক বেয়ে গলা মোমের মতো গড়িয়ে নামছে।
পরদিন থেকে আমি টাউনে নিজের মতো ঘুরব ভেবেছিলাম, এলোমেলো উদ্দেশ্যহীন। আমি নিশ্বাস ফেলে চারপাশে তাকিয়ে দেখেছিলাম, গঞ্জ তার গলিঘুঁজি চোরাপথে নিজের ভেতর লুকিয়ে রেখেছে অনেকগুলো আলাদা গঞ্জ। কুবলাই খানের কাছে মার্কো পোলো যেরকম কিছু কিছু শহরের বর্ণনা দিয়েছিলেন যাদের ভেতর জেগে আছে এক বা একাধিক প্রতিরূপ, সেই হিডন সিটিদের মতোই গঞ্জ যেন আমাকে ইশারা পাঠাত। প্রলুব্ধ করত তার পেটের ভেতর আততায়ীর প্রেমের মতো সযত্নে লুকোনো অতিকথা ও গল্পদের খুঁজে বার করতে। পরিত্যক্ত বাংলো, রাত্রের জোনাকি ও ঝিঁঝির কনসার্ট, কুমারপাত্রা নদীর কলোরাডো ভূমিরূপ, ভগ্ন চার্চের অন্দরে বাতাসের ফিসফিসানি, ফাঁকা টেনিস কোর্ট, প্ল্যাটফর্মবিহীন ছোট্ট স্টেশন, তার ওপারের বেরিয়াল গ্রাউন্ড যেখানে আমি এক অ্যাংলো তরুণীকে প্রতি বিকেল বেলা বসে থাকতে দেখি, এখানে-ওখানে বেখাপ্পা হনুমান মন্দির, তাদের মাথায় উড়ছে গেরুয়া ঝান্ডা, বাদামি চামড়ার অ্যাংলো বৃদ্ধর শরীরজোড়া মাকড়সার জাল। কখনো দেখেছি খেতের প্রান্তে বসে গমের শিষ ছিঁড়ে খাওয়া শ্রান্ত পথিক, ওরাওঁ রমণীর চোখের নীচে স্থায়ী অন্ধকার, মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভাঙা অটো, বিকেলের মরা আলো যেন দেশি কইয়ের পেটের মতো হলুদ— এই সমস্তই গঞ্জকে সিপিয়া টোনে রাঙায়। রাত ঘনায় যখন, ঘুমের চাদরে টাউনকে মোড়ানোর পরিকল্পনা বানচাল করে আচমকা স্থানীয় ক্যারম দলের ম্যাচ জেতার উল্লাস ছিটকে আসে জীর্ণ ক্লাবঘর থেকে। মহুয়াবনের ভেতর মাথার কাঠকুটো একপাশে নামিয়ে হাফপ্যান্টের পকেটে আঙুল গলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে দেহাতি মেয়ে, একপাশে হেলানো তার গাল, হাতে ভর রেখে, টুরিস্টের চোখে এ সমস্তই ক্যামেরার সম্পদ। কিন্তু ফ্রেম ছাড়িয়ে যেটুকু, তাদের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকে লোকালয়ের ইতিহাস। তার গড়ে ওঠার মুখে আদিবাসীদের সঙ্গে সাহেবদের সংঘাতের ইতিহাস। অরণ্যের ভেতর থেকে জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে থাকা ভাল্লুক ও চিতাবাঘের অসহায় ক্রোধের ইতিহাস। অনতিঅতীতে যাদের শিকারের মহোৎসব শুরু করেছিল সেটলাররা। অসংখ্য নামগোত্রহীন মুন্ডা ওরাওঁদের গল্পের গায়ে জন্মানো ঘাস, মরা গাছ, থ্যাঁতা কুয়াশা আর জঙ্গলের মধ্যে মধ্যে খুদে গ্রামগুলো, আরও অনেক কিছু যাদের অবহেলায় ঝরিয়ে দিই রোজ আমাদের স্মার্টফোনের ফ্রেম থেকে। সে-ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখে গঞ্জ। তার নাগাল টুরিস্টরা পাবে না।
বারবারা আমাকে না-চিনেও হাত নেড়ে ডেকেছিল, 'এসো।' কারণ, বহুকাল এখানে কেউ আসেনি।
.
.
.
নৈশ অপেরা
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
মুদ্রিত মূল্য : ৫৪০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment