বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।
‘স্বর্গে ছিলেক নারী, 'নারি' নামো ধরে;
নর নোকে আনি' জুদায় ফোড় করে।
কাম নাই, কাজ নাই—
সোদায় গোড়ত-গোড়ত করে।
থাকের উপর থাক
তারে উপর কালা কুক্কা
তারে উপর বায়।
ধাঁধা দুইটির আবডাল সরিয়ে চিনতে পারা গেল কি বস্তুটি কী? বেশ, আরেকটু সহজ ইঙ্গিত দেওয়া যাক তবে।
যার মাথায় আগুন পেটে পানি তারে আমি ওস্তাদ মানি।
একটু একটু আন্দাজ করতে পারা যাচ্ছে এইবারে, তাই না? নিজের মাথায় ধিকিধিকি আগুন জ্বেলে রসিকের মন মাথা বরফিলা করতে যার জুড়ি মেলা ভার, সেই 'অ্যাসাইটিস'-ওয়ালা বস্তুটি হুঁকো ছাড়া আর কী-ই বা হবে!? হ্যাঁ, তৃতীয়টির মতোই প্রথম দুটিরও উত্তর হুঁকো। কিঞ্চিৎ ব্যাখ্যা করলে আমাদের বুঝতে সুবিধা হতে পারে। গ্রিক পুরাণে বলে, প্রমিথিউস স্বর্গ থেকে আগুন নিয়ে এসেছিলেন মানুষের প্রয়োজনে। অ্যাসকাইলাস ও বোকাচ্চিও থেকে গ্যেটে হয়ে বায়রন ও শেলী— সকলেই বিভিন্ন সময়ে সেই পৌরাণিক গাথা নিয়ে গেঁথেছিলেন অনবদ্য সব বীরত্ব আখ্যান। সেই গল্প মাথায় রাখলে এই ধাঁধাটি আদতে একটি চমৎকার মক হেরোইক ন্যারেটিভ মনে হবে।
কীভাবে?
এটির বক্তব্য স্বর্গবাসিনী নারী-কে মানুষ নামিয়ে এনেছে নরলোকে। তারপর জুদায় ফোড় করেছে অর্থাৎ এক জোড়া ফুটো করেছে তার গায়ে। অতীব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি আসছে এইবারে। তা হলো, এই যে খানিক তোড়-ফোড় করা হলো নারী-শরীরে, এতে করে সে নারী সম্ভবত বেজায় দুঃখিত হলো, কিঞ্চিৎ ক্ষেপেও উঠল, লেগেছে তো বিষম ব্যথা! সে কী করল, কাজকর্ম কিচ্ছুটি না করে, গোঁসা ধরে, দিনরাত কেবল গোড়ত গোড়ত শব্দ সহকারে গোঙাতে লাগল। বিষয়টি খোলসা হলে যা দাঁড়ায়—
এখানে নারি হলো নারিকেল ফল। গাছগুলো পেল্লায় ঢ্যাঙা, প্রায় আসমান ফুঁড়ে উঠে গেছে এ তো হর-হামেশা দেখা যায়, অতএব মুণ্ডু তার স্বর্গ ছুঁয়ে ফেলেছে এটা বললে মোটেই বিশেষ কিছু দোষের নয়। এইবারে সেই মুণ্ডুতে যা ফলে তা এক অর্থে স্বর্গীয়ই বটে! ধাঁধা বলছে সে টঙে বসে থাকা ফলটি স্বর্গ-ছেঁড়া হয়ে মাটিতে নামে মানুষের নিপুণ দক্ষতায়। এরপর বিভিন্ন প্রয়োজনে সেটির ব্যবহার শুরু হয়। তেমনই একটি ব্যবহার হলো ধূমপানের মাধ্যম হয়ে ওঠা। ধূম্র-মৌজের ক্ষেত্রে তামাক-গুলি-টিকে প্রভৃতি আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাদি শুরুর আগে নারিকেলের ফাঁকা খোলার গায়ে দুটি গর্ত করে একটিতে নলচে বসালেই কেল্লা আধেক খতম। নলচের মাথায় কলকে বসিয়ে, তাতে তামাক ধরিয়ে, নারিকেলের গায়ের আরেকটি গর্তে ঠোঁট ছুঁইয়ে শ্বাসের টান পড়ল কী—ঐ গোড়ত গোড়ত চালু।
আশা করি প্রথম ধাঁধার বক্তব্য স্পষ্ট হলো।
এইবারে আসা যাক দ্বিতীয় ধাঁধায়।
একাধিক থাকের ইঙ্গিত আছে এতে। সকলের উপরে কালাকুক্কা, তারও উপরে বায়। বেশ, হুঁকোর চেহারাটি একবার ভাবুন দেখি। একটি থেলো হুঁকো খুঁটিয়ে দেখলে জানা যায়—নিচ থেকে ওপরে পরপর অংশগুলো হলো নারকেলের গোটা মালা বা খোল (অনেক জায়গায় ঠালি/টোলা এসব নামেও ডাকা হয়), কাঠের নল বা নলচে (লোকমুখে নলছে/নৈচা/নাছারা নামও প্রচলিত) এবং মাটির ছিলিম বা কলকে। আগেই বলা হয়েছে এই কলকেতেই তামাক পোড়ানোর ব্যবস্থা থাকে, এতে তামাক রেখে তার উপরে ছোট্টমতন মালসায় টিকে বসিয়ে তাতে আগুন ধরানো হয়। ঐ থাকের উপর থাক-এর ব্যাখ্যা তো সহজেই মিলে গেল, কালাকুক্কাটি হলো কলকে এবং বায় হলো একমতে কলকের ভেতরে থাকা আগুন, অন্য মতে সেটি ঘিরে থাকা আগুনে-গরম বাতাস। টিকেটি ওখানেই পুড়ছে কিনা।’
......................................................
খোল নলচে’র হেফাস্টাস-গাথা
দেবযানী ভট্টাচার্য
.......................................
বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা
সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল
মুদ্রিত মূল্য : ৬৯০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment