বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

‘আমাদের এই পোড়া মফস্বলে শীত পড়ে না আর। নরম হয় না রোদ্দুর। শীতের দেশ থেকে আসে না পাখির দল। আর কাশ্মীর থেকে আসে না শালওয়ালা। মফস্বলের অলিগলিতে বাজে না আর নতুন কেনা সবজে হিরো সাইকেলের ক্রিং ক্রিং। সেই কোন ভিনদেশে বাড়ি, অথচ প্রতি বছর শীতের আগের যাতায়াতে গঙ্গা সমতলের ভাষাও কেমন আয়ত্তে এসে যায় তাদের। ছোটোখাটো, মফস্বল ঘেরা নিচু নিচু বাড়ির মা-কাকিমাদের সঙ্গে কেমন করে সখ্যও জমিয়ে ফেলে তারা দ্রুত অথচ ধীর লয় আলাপে। কুয়াশা কুয়াশা শীতকালে ঘেরা ছোটো টাউনের সেই মায়েরা যেমন হয় আর কী—তটস্থ সারাদিনই ক্রমশ ছোটো হয়ে আসা দিনের থেকে কুড়িয়ে রাখতে উত্তাপ বাকি সংসারের জন্য। কিন্তু তাও যাবতীয় সেলাই-রিফুর পরেও দরকার হয়ে পড়ে কখনও কখনও নতুন উত্তাপ যোগানের। মুশকিল আসান হিসেবে হাজির তখনই মর্ত্যের স্বর্গ থেকে সমতলে নেমে আসা লম্বা-চওড়া আর আপেলের মতো টুকটুকে রঙের শালওয়ালা। বেলা একটু বাড়লেই, দোহারা বাড়ির গেটের সামনে ক্রিং ক্রিং। ভাঙা ভাঙা বাংলা। “কী লাগবে মাসিমা? ও বৌদি, কী লাগবে?”

শালওয়ালার চোখ ছিল নীল রঙের। তার সাইকেলের পিছনের সিটে বাঁধা কালো ব্যাগে শুধু কম্বলই নয়, বরং রং-বেরঙের নতুন একটা দেশ। কার্পেট, কাজ করা কাপড়, শাল। কার্পেট বা শাল তো বোঝা গেল। কিন্তু কাজ করা কাপড়ের ব্যবহার কী? ব্যবহার নানা রকম। ঘরের ছোটো সাদাকালো টিভি বা রেডিও ঢাকা দিতে লাগে। আবার বাড়িতে লোকজন এলে পেতে দেওয়া যায় চেয়ারের পিঠের দিকেও। 

কিন্তু লাগলেই বা তার যোগাড় হচ্ছে কী করে? বাড়ির মা-কাকিমাদের হাতে সেই যোগান কই? এদিকে কর্তার কাছে যে চাওয়া হবে, সকলেরই প্রায় মাসকাবারির খরচ বাঁধা। কোনোদিকে একটু বাড়তি সঙ্কুলান করতে, টান পড়ে অন্য দিকে অবধারিতভাবেই। সুতরাং নতুন কিছুর দাবি উঠলেই, চলে যাচ্ছে কীনা, সেই প্রশ্ন ওঠে সবার আগে। অগত্যা উপায়?

কেমন করে যেন পাড়ার মা-কাকিমারা সেই মুহূর্তেই একটা গোল টেবিল বৈঠক করে নেয় নিজেদের মধ্যেই। নতুন জিনিস কার না দরকার? কিন্তু কার যে সব থেকে বেশি দরকার, আত্মার থেকেও বেশি আত্মীয়তার সূত্রেই সেটা মোটামুটি জানাই থাকে পাড়ার সকলেরই। নিজের নিজের ভাঁড়ার থেকে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে সেই সঞ্চয় তুলে দেয় তারা সব থেকে বেশি প্রয়োজনের কাছে। পুরোটা যোগাড় হয় না তবু। যেটুকু বাকি থাকে, সেটুকু বাকির খাতায় তুলে রাখে শালওয়ালা। পরের বছর দেখা যাবে! বছর-বছর ধরে যে এই জমতে থাকে উত্তাপের ঋণ, তার সুদ-আসলের হিসাব কেই বা এখন রাখে আর?

বরং পশম পশম দিন নেমে আসে স্মৃতির মফস্বল জুড়ে। সেই পশমে বোনা বাকির খাতার কম্বলের নিচে শুলে, কিছুতেই তার থেকে বেরোতে ইচ্ছা হয় না বিচ্ছুটার। স্কুলে দেরি হয়ে যায়। বারবার ডাক দেয় মা। কিন্তু গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকতে যে কী আরাম! তাই আচমকাই গা থেকে মা কম্বল টেনে নিলে, দু'চোখ ফেটে যেন জল আসতে চায় তার। শনিবার। তাড়াতাড়ি ছুটি স্কুলে। আজকে জামা নোংরা হলে সমস্যা নেই। স্কুলের মাঠে কবাডির কোর্ট কাটা হয় তাই। আর চুলে-মাথায় ধুলো নিয়ে ফিরতে ফিরতে ক্লাস ফোরের বিচ্ছুর কানে ভেসে আসে আচমকা বহু চেনা ক্রিং ক্রিং সেই। শালওয়ালা হাসে তার দিয়ে তাকিয়ে। কিন্তু সেও উল্টে শালওয়ালার দিকে তাকিয়ে হাসবে কী? বরং চোখ আটকে গেছে সামনে ডানদিকের বাড়ির ব্যালকনিতে। রূপসাদি অমন করে দৌড়ে বাইরে এল কেন? অমন করে তাকিয়ে রইল কেন সাইকেল নিয়ে এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া শালওয়ালাটার দিকে?'
......................................................

শীত পালানো মফস্বল আর নীল চোখের শালওয়ালা
শুভদীপ চক্রবর্তী
.......................................
বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা
সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়

অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল

মুদ্রিত মূল্য : ৬৯০ টাকা

সুপ্রকাশ


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।