বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়

‘তখন খুব ছোটো। নানি আমার শরীরে সর্ষের তেল মাখাতে মাখাতে গাইছেন-'কে আমার রসিক নাগর, আমার আপেলের বাগানে এসেছে? কে আমার রসিক নাগর...'। শুনে তো আমি হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার মতন। নানিকে জিজ্ঞাসা করলাম- 'নানি অ্যা কি গান গাহাইছেন গো?' নানি বললেন-'এইটো হলো বিহ্যার গীদ, বুঝল্যা ভাই? তুমার যখন বিহ্যা হবে তখুন তুমার গায়ে হলদি-ত্যাল মাখাবো আর গান গাহাবো। আর বড়ো সাউনবক্স ভাড়া করে লিয়ে এসে ড্যান্সও দিবো কিন্ত'। শুনে তো আমার মুখ লজ্জায় লাল। মা মারা যাওয়ার পর এক বিধবা নিরক্ষরা নারীর কাছে আমার বেড়ে ওঠা। তাঁর থেকে শেখাও অনেক কিছু।

নানীর সাহচর্যে থেকেই কীনা জানিনা বিয়ের গীত, বিয়ে গাউনি শব্দগুলো শুনলে ছোটোবেলার মায়া মাখানো এক টান টের পাই ভেতর থেকে। সে মায়ার টানে পরবর্তী সময়েও বহু বিয়ে গাউনি শিল্পীদের কাছ থেকে দেখা এবং সাহচর্য পাওয়াও। রসিদা বিবি, সাইরা বিবি, লাইলা বিবি কত নাম...। তাঁদের থেকে শোনা বিয়ে গাউনি, মিরাশিন পেশা নিয়ে কত নতুন-পুরোনো গল্প। স্মৃতি। 

পশ্চিমবঙ্গের যে অঞ্চলটিতে আমাদের বাস সেটি মুর্শিদাবাদের ভাগিরথী নদীর পশ্চিমপাড়। মহকুমা কান্দী। এক কথায় রাঢ় বাংলা। ফলত কথ্য রাঢ়ী উপভাষার ব্যবহার এতদঞ্চলে লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু বিয়ের গীত, বিয়ে গাউনি, মিরাশিন পেশা শুধুমাত্র এ অঞ্চলের বাঙালি মুসলমান পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বর্ধমান, বীরভূম, মেদিনীপুর, মালদা সহ তার ব্যপ্তি উত্তরে আসাম, ত্রিপুরা থেকে দক্ষিণে সুন্দরবন এবং পূর্বে বর্তমান বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটি থেকে পশ্চিমে বিহারের পূর্নিয়া অঞ্চল পর্যন্ত। একটা সময় ছিল যখন গীত ছাড়া আর্থিকভাবে সচ্ছল মুসলমান গেরস্থবাড়িতে বিয়ে-শাদীর অনুষ্ঠান কল্পনা করা যেত না। বিয়ের অনুষ্ঠানবাড়িতে দেখা যেত এক ঘরে কনে সেজেগুজে ফুল দিয়ে সাজানো জলচৌকির উপরে সমবয়েসী আত্মীয়া পরিবেষ্টিত হয়ে বসা আর সে ঘরেই একদল বিবিধ বয়েসী মহিলা বিয়ের গীত গাইছেন। গীত গাইতে গাইতে নিজেদের ভঙ্গীমায় নাচতেনও তাঁরা। আবার আশেপাশে উপস্থিত বাড়ির মধ্যবয়েসী আত্মীয়ারাও তাঁদের গীতের তালে তালে নাচ-গানে মেতে উঠতেন।

নানীর সাহচর্যে থেকে ছোটোবেলা থেকে প্রচুর বাড়িতে এই বিষয়গুলো লক্ষ্য করেছি। পাড়ায় অথবা গ্রামে কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান হলেই বিয়ে গাউনি হিসেবে নানীর ডাক পড়তো, যদিও তিনি পেশাদার বিয়ে গাউনি ছিলেন না। আর সবসময়ই নানীর সঙ্গী আমি আর আমার বড়োবুবু। যে কোনো সাংস্কৃতিক চর্চার ক্ষেত্রেই যে বিষয়টি প্রত্যক্ষ করা যায়, প্রতিভা আর নিরলস চর্চা সাপেক্ষে শিল্পীসত্ত্বার বিকাশ-মুসলমান সমাজ-সংস্কৃতির বিয়ের গীত ধারাটিও তার ব্যতিক্রম নয়। বাঙালি মুসলমান গৃহস্থবাড়ির অন্দরমহলের আনন্দ উদযাপন হিসেবে বিয়ের গীতের উদ্ভব হলেও কালক্রমে একেই পেশা হিসেবে ধারণ করে কেউ কেউ বিয়ে গাউনি শিল্পী হিসেবে বিশেষ পরিচিত হয়ে উঠলেন। যে কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে তাঁদের সমাদর বাড়লো। বিয়ের অনুষ্ঠানের মাসখানেক আগে থেকে ভালো শিল্পীদের বায়না করে রাখার চল প্রচলিত হলো।

কিন্তু তখনো বিয়ে গাউনি ঠিক পেশা হয়ে উঠেনি। বিয়ে গাউনিরা বিয়ের দাওয়াত-আচার অনুষ্ঠানের অঙ্গ হয়ে উঠলেন বটে, কিন্তু আদতে জীবিকার ক্ষেত্রে তাঁদের পরিচয় গৃহবধূ-ই। বিয়েবাড়িতে তাঁরা বিয়ের নানা স্ত্রী আচারের কাজে অংশ নেবেন, পাশাপাশিও গানও গাইবেন। বিয়েবাড়িতেই তাঁদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হতো। কখনো কোনো বাড়ির গৃহিনী হয়তো শাড়ি-পোশাক কিছু উপহার দিলেন। বিয়ে মিটে গেলে আবার যে যার গন্তব্যে। পশ্চিমবঙ্গের অঞ্চল নিরিখে এইসব শিল্পী বা শিল্পীদলের নামও আলাদা আলাদা। যেমন বর্ধমান জেলায় তাঁদের বলা হয় 'গীতগাহুনি' বা 'গীতগাউনি', বীরভূম, মালদা, মুর্শিদাবাদে তাঁরা পরিচিত 'গীত গাহিরি' নামে। আবার উত্তরবঙ্গে এই শিল্পীদের বলা হয়ে থাকে 'গীতলি' বা 'গিদালি'।

পেশা হিসেবে তার রূপায়ণ 'মিরাশিন' দলের হাত ধরে। ষাটের দশক অব্দি বর্ধিষ্ণু মুসলমান বিয়ে বাড়িতে আলকাপ, রায়বেঁশে, লেটো ইত্যাদি পুরুষপ্রধান লোকশিল্পীগোষ্ঠীর সাথে সাথে 'মিরাশিন' দলকেও বায়না করে নিয়ে আসা হতো। 
বিয়ে গাউনি এবং মিরাশিন দল একই ধারার বিয়ের গীত, কাপ ইত্যাদি উপস্থাপনা করলেও তাঁদের মধ্যে সুক্ষ্ম এবং স্পষ্ট একটি পার্থক্য ছিল। মিরাশিন দলের শিল্পীরা পেশাদার শিল্পী ছিলেন এবং গ্রামবাংলার নানা জায়গায়—পারিবারির অনুষ্ঠান থেকে বারোয়ারি মঞ্চ—দুজায়গাতেই বৃহত্তর দর্শক পরিসরে তাঁরা বিয়ের গীত, কাপ ইত্যাদি পরিবেশন করতেন। এবং বিয়ের গীতের মাধ্যমেই এঁরা জীবিকা নির্বাহ করতেন। তবে শুধু বিয়ের অনুষ্ঠান-ই নয়। বর্ধিষ্ণু মুসলমান বাড়ির অন্যান্য অনুষ্ঠান যেমন, নাক ফুটা, কান ফুটা, খৎনা, আকিকা ইত্যাদি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানেও মিরাশিন দলের ডাক পড়তো। এককালে মুসলমান বাড়িতেও সন্তানাদি জন্মানোর পর মায়েদের টানা চল্লিশ দিন আঁতুড়ঘরে কাটাতে হতো। চল্লিশ দিন পর আঁতুড়ঘর থেকে মূল ঘরে ফিরে আসা উপলক্ষেও অনেক পরিবারে আনন্দ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। সেসব অনুষ্ঠানেও মিরাশিন শিল্পীদের ডাক পড়তো।'

.......................................
বিয়ে গাউনি থেকে মিরাশিন
মীর রাকেশ রৌশান
.....................................
বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা
সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়

অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল

মুদ্রিত মূল্য : ৬৯০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।