বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

‘হ্যালো, হ্যালো, এক-দুই-তিন... হ্যালো...

কিংবা—একটি ঘোষণা, আজ বৈকাল চার ঘটিকায়...

নাহ্, সেই সুর তো কানে বাজছে না। এতো অন্য কণ্ঠ। রিক্সায় মাইক বেঁধে একটি বস্ত্রবিপণির বিপুল ছাড়ের ঘোষণা করে যাচ্ছে, কিন্তু সেই কণ্ঠ উদাত্ত, ভারি, ভরাট... নাহ, তেমন নয়, সে কণ্ঠ ছিল গোরাদার, লম্বা, ফর্সা, ঘাড়ের পিছনে অনেকটা চুল নামানো, ইউকাট—সেই সময় খুব চলত কীনা।

কয়েক বছর পর শহরে ফিরেছি। চোখ ফিরিয়ে দেখলে নজরে পড়ে অনেক কিছুর বদল। তাহলে গোরাদাও কি বদলে গেল?

না। গোরাদা আর নেই। সে এখন অন্য পৃথিবীতে। অথচ একটা সময় ছিল, শহরের মানুষকে কোনও কিছু জানানোর প্রয়োজন পড়লেই হালদার ইলেকট্রিক্সের শব্দযন্ত্র আর গোরাদার কণ্ঠ—

'আনন্দ সংবাদ, আনন্দ সংবাদ, আনন্দ সংবাদ। আজ সন্ধ্যা ছয় ঘটিকায় কালীমাতা হাই ইস্কুল প্রাঙ্গণে বিশ্ব বিখ্যাত যাদুকর পি সি সরকারের যাদু প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হইবে এ-এ-এ....। টিকিটের মূল্য এক টাকা, দুই, টাকা পাঁচ টাকা। আগে এলে আগে পাবেন...'

রিক্সার চাকা গড়িয়ে যায়। কিংবা ঘোষণা থামিয়ে হ্যান্ডবিল বিলি করা হয়। হলুদ রঙের সেই হ্যান্ডবিল মানুষের হাতে ধরিয়ে দেওয়াও ছিল তার কাজ। শহরবাসীর চোখ এসব দেখতে অভ্যস্ত ছিল।

সেই গোরাদা নেই! অথচ সেই সময়ে মানে সত্তরের দিনগুলো শহর আর গোরাদা পরিপূরক হয়ে উঠেছিল। ওই কণ্ঠের আকর্ষণে আমিও কেমন যেন আটকে যেতাম এই শহরে, গোরার সঙ্গে। তখন একটা স্কুলে মাস্টারির সূত্রে শহরে বাসা বেঁধেছি। ভাড়া বাড়ি। গ্রাম থেকে এসেছি শহরে। শহর ঠিক নয় আধা শহর। বাজার থেকে বড় রাস্তা ঢলে গেছে আমাদের ইস্কুলের দিকে। পথের পাশে ছিটেবেড়ার চায়ের দোকান। চায়ের গেলাসে চুমুক দিচ্ছি। এমন সময় একটা ভরাট কন্ঠ এগিয়ে আসছে— 'আজ সন্ধ্যা আটটায় কলিকাতার বিখ্যাত যাত্রা কোম্পানি—নট্ট কোম্পানির যাত্রাপালা নটীই বিনোদিনী... নটী ই ই বিনোওদিনীই। শ্রেষ্ঠাংশে যাত্রারাণী বীণা দাশগুপ্ত...'

চাকা গড়িয়ে যায়। পাশ থেকে এক মাস্টারমশাই বললেন—চিনে রাখুন এ হলো আমাদের লোকাল দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।

কয়েক বছর আগেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়ে গেছে। ওই মুক্তিযুদ্ধের সুবাদে আকাশবাণী বাহিত দেবদুলালের কণ্ঠস্বর গ্রামবাংলার বাতাসে ছড়িয়ে গেছে। আধা মফঃস্বলী শহরের ভরাট কন্ঠস্বরের অধিকারী ঘোষকও সেই পদ্মশ্রী প্রাপকের তুলনীয় হয়ে গেছে মানুষের কানে কানে। সারা বছর বিবিধ ঘোষণা চলতেই থাকে। কখনও দোকান উদ্বোধন, কখনও দোকানে দামের ছাড়! এছাড়া যাত্রা, থিয়েটার, ফাংশান, সার্কাস, এবং সিনেমা—হ্যাঁ সিনেমা। এলাকার একমাত্র সিনেমা হল 'ছবিঘর'। প্রতি শুক্রুবার গোরাদা ঘোষণা করে সবাইকে জানিয়ে দেয় কী ছবি দেখানো হবে বা হচ্ছে। সিনেমা দেয়ার সময়।

ছবিঘর সিনেমা হলে এলো নতুন ছবি
রাজেশ খান্না-শর্মিলা অভিনীত
'আরাধনা'
তিনটে, ছটা নটা.... তিনটে ... ছটা.... নটা
আরাধনা... আরাধনা’
......................................................

হ্যালো... মাইক টেস্টিং হ্যালো ওয়ান-টু-থ্রি
সমরেন্দ্র মণ্ডল
.......................................
বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা
সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়

অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল

মুদ্রিত মূল্য : ৬৯০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।