বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

‘শীত পেরিয়ে গেলেই খেজুর গুড়ের দিন শেষ। রস হয় না। হলেও টকে যায়। এমনকি আগে থেকে তৈরি করে রাখলেও, খেজুড় গুড় সামান্য গরম পড়লেই টকে যায়। আসে তাল গুড়ের দিন। তালগাছের গায়ে তাল ডাঁটার গোড়া লেগে থাকে না। তাল গাছ মোটা হওয়ায় তাতে বেয়ে ওঠাও সম্ভব না। তাল গাছের গায়ে বাঁধা হতো লম্বা বাঁশ। বাঁশের কঞ্চিগুলো একেবারে গোড়া থেকে না কেটে সামান্য রেখে রেখে কাটা হতো। সেই কঞ্চির গোড়ায় পা দিয়ে দিয়ে তাল গাছের মাথায় ওঠা হতো। তারপর একই পদ্ধতিতে রস আনা। তালগাছে রস হয় বেশি; স্বভাবতই বাঁধতে হতো বড়ো কলসি। রস-ভরা কলসির মুখে দড়ি বেঁধে নামিয়ে দেওয়া হতো। নিচে কাউকে থাকতে হতো ভরা কলসি খুলে নিয়ে, খালি কলসি বেঁধে দেওয়ার জন্য। তালরসে সামান্য চুন মেশানো হতো নামানোর সঙ্গে সঙ্গে। তারপর রস বাড়িতে এনে একই পদ্ধতিতে গুড় তৈরি। খেজুর-গুড় জমিয়ে রাখা যায় না, স্বভাবতই সংরক্ষণ করার উদ্দেশ্যে তালগুড়ের পাকও বেশি হতে হয়। আমাদের ছোটোবেলা অধিকাংশ বাড়িতেই সারাবছরের মাপে গুড় তৈরি করে নেওয়া হতো। নিজেদের গাছ না থাকলে সামান্য বিনিময়-মূল্যে প্রতিবেশির গাছ বায়না নেওয়া হতো। রান্নাবান্নায় বউ-মেয়েদের সুনামের পাশাপাশি গুড় তৈরির মতো গৃহস্থালী কাজে পারঙ্গমতাও খুব বিবেচ্য ছিল।

মূলত কৃষিজীবী গ্রামদেশে অর্থনীতির তারতম্যে সামাজিক সম্মানের খুব কম-বেশি দেখা যেত না। পাড়াগুলো সাধারণত জ্ঞাতি-গোষ্ঠী নিয়ে গড়ে উঠতো। ফলে একই পাড়ায় স্বাচ্ছল্যের তারতম্য থাকলেও সে-সব সামাজিক ক্ষেত্রে খুব গুরুত্ব পেতো না। অবশ্য এই সামাজিক অবস্থা এতটাই টায়টোয় মাপেমাপে ছিল না। কীভাবে যেন উচ্চাবচতা তৈরি হয়ে যেত। আমার পিতৃপুরুষেরা কৃষিজীবী হলেও ঠাকুর্দাদের বা বাপ-কাকাদের কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা কখনই খুব একটা দেখিনি। জমি-জায়গা লোকজন লাগিয়েই চাষবাস হতো। ঠাকুর্দারা এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্মে বাপ- কাকারা আজন্ম হস্টেল মেসে কাটিয়ে কাটিয়ে চাকুরিজীবী। স্বভাবতই কৃষিকর্মে তাঁদের খুব বেশি অংশগ্রহণ ছিল না। কৃষিভিত্তিক সামাজিক জীবনও তাঁদের খুব একটা ছিল না। মামাবাড়ির দিকে জমিজায়গা অনেক বেশি হলেও, দাদামশাই গ্রামের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হলেও, কৃষি এবং কৃষিজীবী জীবনকে আন্তরিক শ্রদ্ধার সঙ্গে লালন করতেন। পরবর্তী প্রজন্মে মামারাও চাকুরির পাশাপাশি কৃষির সঙ্গে ওতোপ্রোত জড়িত। দাদামশায়ের আগ্রহে এবং তত্ত্বাবধানে অতি শৈশবে কিছুদিন বাড়িতে গুড় তৈরির উদ্যোগ ছিল। দাদামশায়ের পর সে সব পাট চুকেছে। ঠাকুর্দা গান্ধী স্মারকনিধি পরিচালিত তালগুড় মহাসংঘ লিমিটেডের অন্যতম কর্তাব্যক্তি এবং প্রচারক। তাঁর প্রতিষ্ঠানে বাণিজ্যিকভাবে তালগুড় উৎপাদন হতো। কিন্তু বাড়িতে তাঁকে কখনও তেমন উদ্যোগ নিতে দেখিনি।

গ্রামদেশে এমন-সব পরিবারে গুড় যোগান দেওয়া এবং আনুষঙ্গিক কাজকর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করার একটি গোষ্ঠী ছিল কয়েক বছর আগেও। তাদের বলতাম সিউলি বা সেউলি। কবিকঙ্কণের চণ্ডীমঙ্গল যাঁদের স্মরণে আছে মনে করতে পারবেন— 'সিউলি নগরে বৈসে, খাজুরের কাটি রসে গুড় করে বিবিধ বিধানে।' মেদিনীপুরে যে-কোনো পরিবারের ছেলেই সিউলি হতো। বৃত্তিগতভাবে তারা কৃষক বা জেলে বা কামার, কুমোর যাই হোক না কেন। শীতের শুরুতে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে তাল-খেজুর গাছ ডাক করতো অর্থাৎ সামান্য অর্থের বিনিময়ে বা নির্দিষ্ট গুড়ের বিনিময়ে ভাড়ায় নিতো তারা। শীতের ক-মাস ভোরবেলা বাঁকে করে বা পরের দিকে সাইকেলে করে রস ফেরি করতো তারা। অনেক বাড়িতে রস কিনে নিয়ে গুড় তৈরি করতো। একটু বেলায় বাড়ি ফিরে বাকি রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি হতো। এলাকার লোকজন সিউলির বাড়ি থেকে টাটকা গুড় কিনতে ভাঁড় হাতে লাইন দিত। আশপাশের বাচ্চারা হাত বা বাটি বাড়ালে বিনি পয়সাতেও মিলত অল্প গুড়। কাউকে বেজার হতে দেখিনি। কখনও সিউলি বাড়ি বাড়ি গুড় ফেরি করে বেড়াতো। সিউলিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল তাদের পাকানো চেহারা। শীতের ভোরেও সামান্য ধুতি বা গামছা মালকোঁচা মেরে গাছে ভাঁড় নামাতে দেখা যেতো সিউলিদের। গা গরম রাখতে তারা কিছুটা রস পান করে নিতো। সামান্য নেশা তাদের খালি গায়ে ওম জোগান দিতো।’
..........................................

সিউলি
শ্রুত্যানন্দ ডাকুয়া
.....................................
বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা
সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়

অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল

মুদ্রিত মূল্য : ৬৯০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।