বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

‘প্রথম যুগে যে সব ইংরেজ কলকাতায় আসতেন তাদের কাছে এখানকার আবহাওয়া ছিল অসহনীয়। গ্রীষ্মপ্রধান কলকাতায় অসহ্য গরমে নাকাল হতে হতো তাদের। মাঝে মাঝে ধুলোর ঝড় উঠতো। বর্ষাকালের বৃষ্টি কিছুটা স্বস্তি দিলেও ভ্যাপসা গরম থেকে রেহাই পাওয়া ছিল মুশকিল। নন্দকুমারের বিচার চলাকালীন ইম্পে ব্যারিস্টার ফেরারকে বলছেন: 'মিস্টার ফেরার! এই গ্রীষ্মপ্রধান দেশে কখনও পূর্ণ নিদ্রা হয় না। আমরা নিদ্রিতাবস্থায় প্রায় অর্ধজাগ্রত থাকি।' বেশ কিছুকাল পরে লর্ড ওয়েলেসলি লিখেছেন: 'দুপুরবেলার গনগনে রোদের তাপ এখানে সারা বছরই। যে যেমন ধাতের লোকই হোক না কেন, গরমে এখানে সকলেই পঙ্গু। তাই সন্ধ্যের পর কাজকর্মে সকলেরই হাত- পা অচল-অবশ।’ জেমাইমা কিন্ডারসলে কলকাতায় এসেছিলেন সেই কোন সুদূর অতীতে ১৭৬৫ সালে। তাঁর অধিকাংশ লেখা চিঠিপত্রের মাধ্যমে। এক চিঠিতে লিখেছেন: 'কাঠ বা কাগজের ব্যবহার কলকাতায় অচল। বাড়ি বানানোর সময় এই দুটো বস্তু বাদ দিয়ে করতে হবে। পোকামাকড় আর অস্বাভাবিক গরমের জন্য এই ব্যবস্থা।...ঘরগুলো বেশিরভাগই কাঁচের জানলা দেওয়া।' ১৭৭৭ সালে কিন্ডারসলের লেখা বই বার হয়েছিল লন্ডন থেকে। ১৭৮২-তে আর এক মহিলা এলিজা ফে-র চিঠিপত্রে রয়েছে 'বাড়ির জানালা সব বন্ধ, দড়ির সাহায্যে জানালার ফ্রেম ওঠা নামা করানো হয়। একে 'ব্লাইন্ড স্যাস' বলে। শুধু সেখানে গরম হওয়া দূর করার ব্যবস্থা আছে, আশ্চর্য বোধ হলেও ঐরকম ব্যবস্থায় কাজের জন্য সেরা।' অনেক ইংরেজ সাহেব বাড়িতে খসখসে ব্যবহার করতেন। ১৭৮৯ সালের ১০ মে ডাঃ ক্যাম্পবেল এক চিঠিতে লিখেছিলেন যে, কলকাতায় খসখসের প্রবর্তন অত্যন্ত আনন্দদায়ক পরিকল্পনা। গরমের দিনে সাহেবরা ভিস্তিওয়ালা রাখত। ঘরের জানলা-দরজায় খসখসে টানিয়ে ভিস্তি তাতে সারাদিনই জল ঢেলে যেত। গরমকালের সাহেবপাড়া সম্পর্কে কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখছেন: 

নগরের দক্ষিণেতে যত শ্বেত নর।
খাটায়ে খসের টাট্টি মুড়িয়াছে ঘর।
তাহাতে চামের জল ঢালে নিরন্তর।
তথাচ শীতল নাহি হয় কলেবর।
ও গড ও গড বলি টবেতে উলিয়া।
মনোহর হাঁসা মূর্তি কামিজ খুলিয়া ।।

কিন্তু খসখসে জল ছিটিয়ে দিতে গেলে অনেক সময় বাড়ির সৌন্দর্য নষ্ট হতো, দেওয়ালে দাগ পড়তো। তাছাড়া বৃষ্টি বাদলার দিনে খসখস অকেজো। তাছাড়া ছিল মশা, মাছি, বিভিন্ন পোকার উপদ্রব। সাহেব টাউন গড়ে উঠলেও কলকাতার বেশিরভাগ জায়গা ছিল নোংরা, অপরিষ্কার, খানা-খন্দে ভরা। গ্রাপ্রি উল্লেখ করেছেন যে, এক ধরনের নীল মাছির জন্য খাবারদাবার সব ঢেকে রাখতে হতো, গ্লাসের ওপর দিতে হতো ঢাকনা। এলিজা ফে ১৭৮০ সনে ২৭ সেপ্টেম্বর তারিখে কলকাতা থেকে এক চিঠিতে বন্ধুকে লেখেন: 'এখন সবচেয়ে অস্বস্তিকর হলো এখানকার আবহাওয়া। অত্যন্ত গরম পড়েছে, এবং বাইরের প্রকৃতি মনে হয় দমবন্ধ করে আসে, একটু হাওয়া নেই কোথাও। কতরকমের পোকামাকড় যে সব সময় ঝঙ্কার করছে তার ঠিক নেই। সবচেয়ে অসহ্য হলো এখানকার ছারপোকা ও মাছি।' খসখসের সাহায্যে হয়তো গরমের অসহ্য দুপুরকে মোটামুটিভাবে সহনীয় করা যেত, কিন্তু দিনে রাতের মশা মাছি থেকে রেহাই মিলতো না। এহেন পরিবেশে পাখার প্রয়োজনীয়তা ছিল অবশ্যম্ভাবী। প্রথম যুগে ব্যবহার হতো তালপাখা। মনিবের পাশে দাঁড়িয়ে বাতাস করতো চাকরেরা। ছোটো তালপাখা ছাড়াও ব্যবহার হতো বিশাল বিশাল ডাণ্ডাওয়ালা তালপাখার। (চিত্র ১) সেই সমস্ত পাখার হাতল ছিল প্রায় তিন-চার ফিট লম্বা। শুধুমাত্র তালগাছের পাতাই নয়, বাঁশের কঞ্চি, বাকল, ঘাস, বিভিন্ন রকম কাপড় এমনকি চামড়ার তৈরি পাখারও ব্যবহার হতো। প্যাচপেচে গরমে প্রাণ জুড়োতে হাতপাখার বিকল্প ছিল না। টানা পাখার ব্যবহার শুরু হলে তালপাতার পাখার ব্যবহার যায় কমে। টানা পাখা কীভাবে কলকাতায় এসেছিল তার এক কৌতূহলোদ্দীপক কাহিনী শুনিয়েছেন বাস্টিড। ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ থাকলেও ঘটনাটা বেশ মজার : সেকালে কোনো এক সকালে এক ইউরেশিও ক্লার্ক ফোর্ট উইলিয়ামের খুপরি ঘরে বসে কাজ করছিলেন। মশার কামড়ে কাজকর্ম প্রায় শিকেয় উঠেছে। সর্বাঙ্গ গিয়েছে ফুলে। হঠাৎ ছেলেটি তাঁর টেবিলের আধখানা কাঠ খুলে নিয়ে কড়িকাঠের বীমের সাথে লাগিয়ে একটা মোটা দড়ি বেঁধে সেই দড়িটা হতভম্ব এক বেয়ারার হাতে দিয়ে বলেছিলেন: 'টান ব্যাটা এটা।' ব্যাস, সেই দিন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল কলকাতায় টানা পাখার যুগ। তবে টানা পাখার হাওয়া কতটা স্বস্তি দিতে পারে সে বিষয়ে হেস্টিংস আর ফ্রান্সিসের যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। সেইজন্য তারা হাতপাখার হাওয়াই বেশি পছন্দ করতেন। মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় এসেছিলেন লর্ড ম্যাকারটোনে। খেতে বসলে টানা পাখার বাতাস করা হতো। ব্যাপারটা তাঁর কাছে রীতিমতো বিলাসিতা বলে মনে হয়েছিল।

প্রথম দিকে সব ঘরে টানাপাখার ব্যবহার ছিল না। ছোটো আকারের পাখা ব্যবহার করা হতো। কর্নেল উইলিয়ামসনের ১৮১০ সালের লেখা বইতে যে সব ভূত্যের কথা বলা আছে, যেমন: মশালচি, হুঁকোবরদার, খানসামা ইত্যাদি সেখানে পাখা টানার আলাদা কোনো লোকের উল্লেখ নেই। মনে হয় পাঙ্খাওয়ালা পদের তখনও উদ্ভব হয়নি। খালাসিরাই অন্যান্য অনেক কাজের সাথে একাজও করত। উইলিয়ামসনের সেই বইয়ের সাথে ছবি এঁকেছিলেন বিখ্যাত চিত্রকর চার্লস ডয়লি। (চিত্র ২, ৩)। বাহারি টানাপাখার যে কদর বাড়ছিল তার প্রমাণ এই ছবিগুলো। সাহেব-মেম পরিবার নিয়ে খেতে বসেছেন কিংবা অফিসে সাহেব কাজ করছেন, মাথার উপর দুলছে পাখা। নেটিভ মানুষগুলো খালিপায়ে দাঁড়িয়ে পাখা টেনে চলেছে। লক্ষণীয় যে বসার ঘরে কোনো টানাপাখা নেই। হাতপাখার হওয়া খাচ্ছেন মেমসাহেবরা, কিন্তু খাওয়ার ঘরে টানাপাখার ব্যবস্থা রয়েছে। (চিত্র ৪) খালাসিরা ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়েই বাতাস করছে। এর পর অবশ্য প্রায় সব ঘরেই টানা পাখা লাগানোর বন্দোবস্ত হয়। (চিত্র ৫, ৬) শুধু তাই নয়, পাঙ্খাওয়ালা পদের উৎপত্তি হয়।’
......................................................

টানা পাখা ও পাঙ্খাওয়ালা : লেখায়, রেখায়
জয়দীপ মিত্র 
.......................................
বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা
সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়

অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল

মুদ্রিত মূল্য : ৬৯০ টাকা

সুপ্রকাশ


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।