বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়

‘শান দেওয়ার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাচ্ছি, সেই আদিম কাল থেকে মানুষ শান দেওয়া হাতিয়ারের কদর বুঝেছিল। ভোঁতা পাথরের তুলনায় ধারালো পাথরের ব্যবহারের কথা আমরা সবাই ইতিহাসে পড়েছি। খ্রীস্টপূর্ব পঞ্চম সহস্রাব্দের কাছাকাছি সময়ে মানুষ কাঁচামাল হিসেবে লোহার ব্যবহার শেখে এবং ধাতুর প্রক্রিয়াকরণ শেখে। খ্রীস্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দীতে ভারত, ককেশাস এবং তুরস্কের কিছু বিশেষ অঞ্চলে ইস্পাত গলানোর কাজ হয়েছে। কিন্তু এইসময় কিভাবে যে হাতিয়ার ধার দেওয়া হতো সে ব্যাপারে কিছু জানা যায় না। ধারণা করা হয়-তখন প্রাকৃতিক পাথর-ই ছিল হাতিয়ার ধারালো করার মূল উৎস। প্রধানত সিলিসিয়াস সেল, বালিপাথর বা বিভিন্ন ধরণের জ্যাস্পার দিয়ে হাতিয়ার ধার দেওয়া হতো। প্রাচীন গ্রীস ইতিহাসে আবার পাওয়া যাচ্ছে 'ক্রিটান স্টোন'-এর কথা। পাথরের উপর বালির মতো ধারালো কোনো ধুলো রেখে শান দেওয়ার কথাও অনুমান করা হয়।

সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে শান দেওয়ার মেশিনেও দ্রুত পরিবর্তন আসে। বাণিজ্য এবং সুরক্ষার কারণে তখন শান দেওয়া ব্যক্তিদের কদর বাড়তে শুরু করে। সেই সময় শান দেওয়ার মানুষেরা ছুরি তৈরি করতে এবং তাকে তীক্ষ্ণ করে ধারালো করে তুলতে অত্যন্ত দক্ষ হয়ে ওঠেন। এই জীবিকার মধ্যে তখন গোষ্ঠীকেন্দ্রিকতা দেখা গিয়েছিল। এক একটি গোষ্ঠীর শানওয়ালারা তখন প্রবল বিক্রমে তাঁদের পেশা চালিয়ে গেছেন। এর মধ্যে এল ঐতিহাসিক শিল্প বিপ্লব। শিল্প বিপ্লব ছুরি ধারালো করার শিল্পে অসম্ভব অগ্রগতি নিয়ে এল। আবিষ্কার হল দুটি চাকা যুক্ত শান দেওয়ার যন্ত্র, যাকে বলা হতো 'ফুট ড্রাইভ' বা 'ক্র্যাঙ্ক ড্রাইভ'। এই যন্ত্রটিকেই আমরা দেখেছি আমাদের ছোটোবেলায় শান দেওয়ার যন্ত্র হিসেবে। যন্ত্রটিকে ক্রমে সাইকেলের সাথে জুড়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত হয়। বৈদ্যুতিক ড্রাইভের আবিষ্কার হওয়ার আগে পর্যন্ত এটিই ছিল সবচেয়ে প্রচলিত এবং জনপ্রিয় শান দেওয়ার মেশিন। কিন্তু বৈদ্যুতিক ড্রাইভ আবিষ্কার হওয়ার পর কী হলো? সে এক যন্ত্রণাময় অধ্যায়। ১৯০০ সাল নাগাদ ফ্রান্সে শান দেওয়ার ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক ড্রাইভের ব্যবহার শুরু হলো। সমস্ত শান দেওয়ার কারখানাতে শ্রমিকদের কাজের সময় ছিল ষোলো ঘণ্টা। বেলেপাথরের সুবৃহৎ চাকার একটু উপরে একটি কাঠের পাটাতন থাকতো। সেই পাটাতনের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে ঝুঁকে তাদের ছুরি ও অন্যান্য সরঞ্জামে ধার দিতে হতো। পাথরের উষ্ণতার সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য তাঁদের হাত রাখতে হতো বরফ ঠান্ডা জলে। ঝুঁকে থাকার জন্য মনে হতো তাঁদের নাক বুঝিবা শান-পাথরটি ছুঁয়ে আছে। এখান থেকে উৎপত্তি হয় ইংরেজি সেই বিখ্যাত প্রবাদ বাক্যের-'নোজ টু দ্য গ্রাইন্ডস্টোন'। ছুরি কাঁচির ঘষ্টানিতে বেলে পাথর থেকে বেরিয়ে আসত হলুদ ধুলো। ধুলোগুলি সেই কাঠের পাটাতন ভেদ করে তাঁদের পেটের কাছে লেগে যেত। এজন্য তাঁদের নাম হয়েছিল 'ভেনত্রে জুয়েনা' বা 'ইয়েলো স্টমাকস'। তাঁরা প্রত্যেকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন একটি করে পোষা কুকুর। কুকুরগুলি তাঁদের পায়ের উপর বসে থাকতো। এতে তাঁরা শুধু যে পোষ্যদের সঙ্গ পেতেন তা নয়, কুকুরদের গায়ের উষ্ণতা তাঁদের প্রাকৃতিক হিটার হিসেবে কাজ করতো। এইভাবে কাজ করতে করতে অচিরেই তাঁদের চোখে হতো কেরাটাইটিস, ফুসফুসে সিলিকোসিস আর শিরদাঁড়া ও হাঁটুতে নেমে আসত অকাল বার্ধক্য। শান শ্রমিকদের এই অসহনীয় জীবন নিয়ে 'লে ভেনত্রে জুয়েনা' নামক একটি অসামান্য উপন্যাস লিখেছিলেন লেখিকা জিন অ্যাংলাড। অবর্ণনীয় দারিদ্র্য, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, খাদ্য সংকট, চিকিৎসা সংকট-এসব কিছুকে অতিক্রম করে কেমন অত্যাশ্চর্যভাবে জীবনধারা বয়ে চলে তার একটি বিদগ্ধ দলিল এই উপন্যাসটি। শান শ্রমিকদের নিয়ে এর চেয়ে ধারালো উপন্যাস আর একটিও নেই। স্টিলের ছুরি-কাঁচির উদ্ভাবন সেদিক থেকে দেখতে গেলে এই সমস্ত শ্রমিকদের একটি ভয়ঙ্কর জীবন থেকে উত্তরণ ঘটানোর কাজটি করেছে।’
................................................
শানওয়ালার কথা
মহুয়া বৈদ্য
.....................................
বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা
সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়

অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল

মুদ্রিত মূল্য : ৬৯০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।