বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

‘দার্জিলিং পাহাড় ও নিচের সমতলের, অর্থাৎ তরাই-ডুয়ার্স এলাকার যে সব বন এখন আমরা দেখি, যেখানে লোকে বেড়াতে আসে, সেই বনের বেশিরভাগটা সায়েব আমলের। ভালো কাঠের ও উৎকৃষ্টতর মুনাফার খোঁজে সায়েবমালিকেরা পুরোনো বনের পুরোটাই প্রায় বদলে ফেলেছিলেন। সাদা সায়েব বিদায়ের পর দিশি সায়েবদের কাল শুরু, সে সময় বাকিটাও মোটামুটি গেলো। বন বদলানো, অর্থাৎ যুগপৎ বন কাটা ও বন তৈরির এই অভিযান টঙিয়া ভিন্ন সম্ভব হতো না।

টঙিয়া ব্যাপারটা খোলসা করা যাক। সায়েবরা এ দেশের জমি জঙ্গল নদী নালা পাহাড় সমতল সব যখন কব্জা করে ফেলেছেন, তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল দখলে আসা এলাকা থেকে কত তাড়াতাড়ি কত বেশি খাজনা আদায় হতে পারে। খাজনা আদায় ও রাজস্ব বা রেভিন্যু বাড়ানোর দুর্মর তাড়নায় বনটন সবকিছুতে যে অমোঘ লুঠেরা থাবা চেপে বসেছিল, সে কথা পূর্বে বলা হয়েছে। শুধু বাংলা নয়, ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষের সর্বত্র এক ঘটনা ঘটেছে, অন্তত বন নিয়ে তো বটেই। দেদার লুটপাটের পর সায়েবরা যখন ঠিক করলেন, শুধু বন কাটলেই চলবে না, বন বানাতেও হবে, কাজটা আদৌ সহজ হলো না। বন সাফ করে কাঠ বেচে দেওয়া সহজ, বনের জমিতে প্রজা বসানোও কঠিন নয়। বন বানানোটা একেবারে অন্য কিসিমের ব্যাপার, বন বিষয়টা কী সেটা আগে সম্যক জানতে-বুঝতে হয়, নিদেনপক্ষে গাছপালা সম্পর্কে একটা প্রাথমিক জ্ঞান তো দরকারি। হিমালয় পাহাড়ের ওক গাছ, নিচের সমতলের শাল গাছ কেটে ফেলা তো হলো। এবার সে গাছের নতুন বন বানানো যায় কিভাবে? উনিশ শতকের মাঝামাঝি, ১৮৬৫ সাল নাগাদ সায়েব সরকার একটা আস্ত নতুন দপ্তরই খুলে ফেললেন, বন দেখাশুনার জন্য। খাস ইংরেজরা এ কাজে দক্ষ নন, ফলে সরকারি বনকর্তা হয়ে আসতে থাকলেন জর্মন সায়েবরা, নিতান্ত না জোগাড় হলে স্কটদেশীয়রা। অবস্থার বিশেষ হেরফের এতে করে হলো না। গাছ কেটে ফেলার পর সে মাটিতে নতুন করে গাছ আর গজায় না। কিছু কিছু গাছের (যথা: শাল, ওক) কাটা গুঁড়ি থেকে নতুন ফেকড়ি বেরিয়ে নতুন গাছ হয় বটে। তাকে বলা হয় কপিস। তবে কপিস হওয়া গাছের অপুষ্ট শীর্ণ কাণ্ডের ব্রহ্মগুণ তুলনায় কম, অর্থাৎ তা থেকে উৎকৃষ্ট ও মূল্যবান দারু/কাষ্ঠ তৈরি হয় না। দামি কাঠ দেওয়া বড়ো আসল গাছ ফিরে না এলে খুব মুশকিল, সায়েব বনকর্তারা সার বুঝলেন। কিন্তু গাছ ফেরানোর উপায়? বীজ কুড়িয়ে চারা তৈরি করে বা সরাসরি বীজ পুঁতে, গাছ তৈরি হচ্ছে না। কী করা যায়?

উপায় বার করে ফেললেন জর্মন সায়েব ডিয়েট্রিচ ব্রান্ডিস, যাঁকে ভারতীয় বনবিদ্যা বা ফরেস্ট্রি-র জনক বলা হয়ে থাকে। বাংলা লাগোয়া বার্মা দেশ তখন ব্রিটিশ দখলে। ব্রান্ডিস খোঁজ নিয়ে দেখলেন সেখানকার দুই ছোকরা সায়েব বনপাল বড়ো কায়দায় নতুন গাছের বন থুড়ি প্ল্যান্টেশান লাগিয়ে ফেলছেন। কি সেই কায়দা, যাতে খরচা নেই বললেই চলে, অথচ লাভ নিশ্চিত?

সেই কায়দাই টঙিয়া। কায়দা বলতে বনের আদি বাসিন্দা জুমিয়া আদিবাসীদের বিনি মজুরির শ্রম। শ্রমের চেয়েও বেশি করে, বন সম্পর্কে তাঁদের বহুদিনের, বহুযুগের জ্ঞান। জুমিয়া বলতে জুম চাষ করেন যাঁরা। যেহেতু জুম চাষ হয় পাহাড়ে বা পাহাড়ি ঢালের বনে, সেই বনের ধরনধারন জুমিয়াদের মতো আর কেই বা বোঝে? টঙিয়াতে সেই বোঝাজানাকে কাজে লাগানো হলো। জুম চাষের জন্য বন কেটে সেখানে আগুন লাগানো হয়। পোড়া গাছ, লতাগুল্মের ছাই মাটিতে পড়ে থাকে, মাটিতে মেশে। সেই মাটিতে ফসলের বীজ ছিটিয়ে দিলে সবজি ও শস্য বাড়ে তাড়াতাড়ি। সায়েবরা যখন জুমিয়াদের বন দখল করে নতুন সব আইনকানুন বানালেন, জুম চাষকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। বনের ভিতর যে জুমিয়া বসতি, সেগুলোকে ভেঙেচুরে পুড়িয়ে দেওয়া হলো। জুম বন্ধের পিছনে সায়েবদের যুক্তি ছিলো আগুন লাগিয়ে দামি গাছ সব পুড়িয়ে নষ্ট করা হচ্ছে, এ সব চলতে দেওয়া যায় না। আগুনকে ভাবা হচ্ছিলো বনের শত্রু। সে সুবাদে, আগুন লাগান যে জুমিয়ারা, তাঁরাও। ভাগ্যের পরিহাস কিম্বা গ্রহের ফের, টঙিয়া প্রথা মারফত জুমিয়া এবং আগুন দুটোই ফেরত এলো আবার। হাতে ধরে, ভুলিয়ে-ভালিয়ে, জুমিয়াদের আবার বনে নিয়ে গেলেন সায়েবরাই। ব্রান্ডিস ততদিনে বুঝে গেছেন, বনে আগুন লাগিয়ে না পোড়ালে, শাল জাতীয় বড়ো গাছের নতুন প্ল্যান্টেশান করা খুব কঠিন। বনে কিভাবে আগুন লাগাতে হবে, কিভাবে বীজ ছড়াতে হবে, কিভাবেই বা বীজ থেকে জন্মানো চারা রোদজল ঠান্ডাগরম রোগব্যাধি পশুপাখি থেকে বাঁচিয়ে বড়ো করে তুলতে হবে, একমাত্র জুমিয়ারাই তা জানেন। সায়েবদের হয়ে কাজ করতে জুমিয়ারা রাজি হলেন কেন? হলেন, কেননা টঙিয়া এলাকায় পোড়া বনের মাটিতে বড়ো গাছের চারা লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের নিজেদের ফসল চাষ করার সুযোগও দেওয়া হলো। টঙিয়া বন হয়ে দাঁড়ালো একাধারে সায়েবদের কাঠের বাগিচা এবং জুম চাষের ক্ষেত।

বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, বা এ তো দিব্যি বন্দোবস্ত! বনকে বন বানিয়ে ফেলা গেলো, চাষও বন্ধ হলো না। আসলে, ব্যাপারটা অতো সরল ছিলো না। জুম চাষের পুরো প্রক্রিয়া ছিলো স্বাধীন, কোথায়, কোন বনের জমিতে, কবে ও কতদিন চাষ হবে, কবেই বা সে জমি ছেড়ে অন্য বনপাহাড়ে উঠে যাওয়া হবে, সবটা ঠিক করতেন চাষিরা নিজেরাই। টঙিয়া যেহেতু আদৌ জুম নয়, জুমের মতো কিছু একটা, ঠিক করাকরির বিষয়টা থাকতো সায়েব বনকর্তা ও তাঁদের দিশি কর্মচারিদের খাসজিম্মায়। যে জুমিয়ারা বুঝে না বুঝে টঙিয়া করতে এলেন, তাঁরা সব বনের কাজের কুলি হয়ে গেলেন। বনের কাজ মানে বনের কাজ। জমি মাপো, বন কাটো, আগুন লাগাও, গাছ ঝোপজঙ্গল পোড়াও, সে আগুন যাতে অন্য বনে না ছড়ায় নজর রাখো। তারপর বনসায়েব বনবাবুদের আদেশমাফিক বীজ ছড়াও সারিবদ্ধ সোজা লাইনে। দু লাইনের মাঝখানের জায়গায় চাষ করতে পারো, কিন্তু খবরদার, বনের গাছের যেন ক্ষতি না হয়।’
......................................................

বন নামে পেশা : টঙিয়া কাহিনী
সৌমিত্র ঘোষ
.......................................
বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা
সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়

অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল

মুদ্রিত মূল্য : ৬৯০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।