বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।


‘ঘরের পাছত মোর হরিয়ারে তাঁতি, শাড়িখান বানেয়া দে' অথবা 'দুয়ারে দাঁড়াইয়া রানি ডাকো দিয়া বলে বাণী, ও তাঁতিয়া, সুন্দর করিয়া গড়িয়ো বিয়ার জোড়'—এরকম গানের পঙক্তি কোচবিহার বা বরিশালেই শুধু নয়, শোনা যেত গোটা বাংলা জুড়েই। কখনো পছন্দ মতো শাড়ি অথবা ছেলে- মেয়ের বিয়ের জোড় বুনে দেবার জন্য আর্জি জানানো হতো ঘরের পাশের পড়শী তাঁতি বন্ধুদের। তাঁতের কাজটা খানিকটা বংশানুক্রমিক কিন্তু মাকু চালাবার আগের এবং পরে নানা ধরনের কাজ করেন তাঁতিঘরের মেয়েরা। এছাড়াও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মেয়েরাই সুতোকাটা, তুলো পরিষ্কার করা—এইসব কাজে যুক্ত থাকতেন; এটাকে তাঁরা সম্মানজনক পেশা হিসেবেই গ্রহণ করতেন। ফলে বস্ত্র শিল্পের ওঠাপড়ায় মেয়েদের জীবনের ওঠাপড়াও জুড়ে থাকতো।

১৯৩৫ সালে প্রবাসীতে ইতিহাসবিদ রাধাগোবিন্দ বসাক একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন 'প্রাচীন ভারতের সুতাকাটায় স্ত্রীসহায়তা'। এখানে তিনি জানাচ্ছেন, অন্যান্য আরো কিছু শিল্পের মতো বস্ত্রবয়ন ও সুতাকর্তন শিল্প যে কেবল গৃহস্থগণ নিজ নিজ তত্ত্বাবধানে স্বাধীনভাবেই সম্পাদন করতেন তা নয় রাজকীয় সূত্র বিভাগেও অনেকে, বিশেষত স্ত্রীলোকেরা কার্যকরী জীবনযাত্রা নির্ধারণের উপায় করে নিতে পারতেন। এই সম্পর্কে তিনি আড়াই হাজার বছর আগের একটি রাজকীয় ব্যবস্থার উল্লেখ করেন। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে দেখা যায় সহায় সম্বলহীনা স্ত্রীলোক, তিনি গৃহস্থবাড়ির বিধবা বা অবিবাহিতা কন্যাই হোন বা সংসার ত্যাগী পরিব্রাজিকাই হোন, রাজকীয় সূত্রবিভাগে নিযুক্ত হতে পারতেন। চোখ ও মস্তিষ্ক শীতল থাকলে সূত্রের উৎকর্ষ হবে—এই বিবেচনায় সরকার থেকে তাঁদের ব্যবহারের জন্য তেল ও আমলকি বিতরণের ব্যবস্থা ছিল। পার্বণ দিনে অতিরিক্ত অশন ও দান দেবার আয়োজন করে তাঁদের দ্বারা অতিরিক্ত সূত্রকর্তনের ব্যবস্থা করা হতো। রাজকীয় সূত্র বিভাগের সূত্রশালায় যাঁরা যোগ দিতে পারতেন না, যাঁদের বাড়ির বাইরে গিয়ে কাজ করার ইচ্ছা ছিল না কিন্তু নিজ পরিশ্রমে অর্থ উপার্জন দ্বারা গ্রাসাচ্ছাদনের উপায় করার ইচ্ছা ছিল, দাসীদের মাধ্যমে তাঁদেরও নিয়োজিত করা হতো। তাহলে দেখা যাচ্ছে, যে সুতো কাটা মেয়েদের এক প্রাচীন জীবিকা। প্রাচীনকাল থেকেই ভারতের যে যে অঞ্চলগুলি বস্ত্রশিল্পে এগিয়েছিল, বাংলা তাদের মধ্যে অন্যতম। এখানকার মেয়েরাও যে সুতো কাটার কাজে লিপ্ত ছিলেন তার নানা উদাহরণ বৈদেশিক পর্যটকদের ভ্রমণ বিবরণীতে পাওয়া যায়। চরকার দৌলতে ধন অর্জনের জন্যই বাংলায় 'ইন্দ্রাণী' নামে এক পুজো প্রচলিত ছিল বলে জানাচ্ছেন রাজেন্দ্রকুমার শাস্ত্রী, ১৩৩৫-এর প্রবাসী পত্রিকাতেই। তিনি বলছেন নামে 'ইন্দ্রাণী' পুজো হলেও তা ছিল আসলে চরকার পুজো; তাঁতে তৈরি একটা কাপড়, চরকায় কাটা কিছু সুতো আর ফলমূল দিয়ে চরকার দৌলতে যাতে ধনসম্পদ বাড়ে তার জন্য এই পুজো করা হতো। কিন্তু ইংরেজ শাসনে চরকার গুরুত্ব কমে যাওয়ায় এই পুজো বাঙালি জীবন থেকে হারিয়ে যায়। চরকা আমাদের জীবনে কতটা জড়িয়ে ছিল, তার কিছুটা আভাস দেয় এই প্রচল।

তাঁতি বা জোলারা কাপড় বোনার কাজটা করলেও, তাঁতে বসার আগে যে নানান ধরনের কাজের পর্ব থাকে সেগুলো প্রধানত করেন তাঁদের বাড়ির মেয়েরা। সুতো কাটার কাজে এক ধরনের আর্দ্রতা বজায় রাখার দরকার হতো; সেই কারণে সকালে খানিকক্ষণ আবার রোদ পড়ে এলে সংসারের কাজ সামলে আরো খানিক্ষণ সুতো কাটার কাজ করা হতো সাধারণভাবে। কিন্তু চাহিদা খুব বেশি হওয়ায় কেউ কেউ সারাদিন ধরেই সুতো কাটতেন, চরকায় বা তকলিতে। রেশমের সুতো সাধারণত তকলিতে কাটা হতো। এত চাহিদার কারণে অন্যান্য নানা সম্প্রদায়ের মেয়েরাও এটাকে পেশা বা জীবিকা বলে গ্রহণ করতেন। সপ্তদশ, অষ্টাদশ শতাব্দীতে যখন বাংলার কাপড়ের চাহিদা তুঙ্গে, তখন লক্ষ লক্ষ মেয়েদের জীবিকার সংস্থান হতো সুতো কেটে। কিন্তু সুতো কাটার সূক্ষ্মতা সবার সমান ছিল না। কেউ কাটতেন অত্যন্ত সূক্ষ্ম সুতো, আবার কেউ কাটতেন মোটা সুতো। এমনই কোনও কাটুনিই হয়তো গেয়েছিলেন এই রকম গান—

মুই কাটুনি সুতা কাটোং অতি বড়ো সরু
তাকে দিয়া বান্দা যায়রে আগা-হালের গরু। (রাজশাহী)

অর্থাৎ তাঁর কাটা সুতো এতই মোটা হতো যে তা দিয়ে গরু বাঁধার দড়ি তৈরি হতো পারে। নিজেকে নিয়ে এ রকম ঠাট্টা করার মতো সুরসিকা ছিলেন বাংলার কাটুনিরা। এর পাশাপাশি এমন কার্টুনিরাও ছিলেন যাঁদের কথা রবার্ট ওরমের মতো লেখকরা উল্লেখ করেছেন। রেশমি সুতোর সূক্ষ্মতাকে যদি এক থেকে কুড়ি পর্যন্ত পর্যায়ে ভাগ করা যায়, এমন দক্ষ কার্টুনিরা ছিলেন যিনি আঙুলের ওপর দিয়ে যখন সুতোটা সরে যাচ্ছে, শুধুমাত্র অনুভব দিয়ে বুঝতে পারছেন যে সূক্ষ্মতা এক থেকে দুই হচ্ছে বা দুই থেকে তিন হচ্ছে। তখন সেখানেই সুতোটা কেটে, পরের ধাপে যেতে পারতেন। এই সমস্ত কার্টুনিদের চাহিদাও ছিল খুব বেশি। কোনও একজন দক্ষ চরকাকাটুনি হয়তো এরকম গান বেঁধেছিলেন—

ওমপুরিয়া চরকা রে মোর দিনাজপুরিয়া হাতা,

চরকার গোড়ে গোড়ে কাটিয়া আননু পাঁচ-পড়শির মাথা। (জলপাইগুড়ি)।’
..........................................

কাটুনি
চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়
.....................................
বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা
সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়

অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল

মুদ্রিত মূল্য : ৬৯০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।