বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

‘একটা সময় যখন শহরগুলোতে পাইপলাইন দিয়ে জল সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল না, তখন ভারীওয়ালা বা ভিস্তিওয়ালাদের ওপরই নির্ভর করতে হতো শহুরে মানুষকে। ছাগলের চামড়ায় তৈরি একধরনের ব্যাগে তারা জল ভর্তি করে শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌঁছে দিত। এই বিশেষভাবে তৈরি ব্যাগকে বলা হতো 'মশক'। অনেকে বলেন, 'বেহেশত' থেকে 'ভিস্তি' কথাটি এসেছে। 'বেহেশত' একটি ফার্সি শব্দ, যার বাংলা অর্থ 'স্বর্গ'। পশ্চিম এশিয়ার সংস্কৃতি অনুযায়ী মনে করা হয়, স্বর্গে রয়েছে প্রচুর নদী, খাল আর বাগান। একটা সময় মানুষের বিশ্বাস ছিল, ভিস্তিওয়ালারা জল নিয়ে আসে স্বর্গ থেকে। স্বর্গের জল তারা মানুষের কাছে পৌঁছে দিত বলে স্বর্গের দূতও বলা হতো তাদের।

পুরোনো কলকাতা বলতেই অনেকের চোখে এখনও ভাসে ভোর-ভোর চায়ের দোকানের উনুন জ্বালানো থেকে গঙ্গা স্নানের জন্য মানুষের ঢল। কিন্তু তার মধ্যেও অনেকেরই চোখে পড়ত ঝকঝকে রাস্তাঘাট আর ভিস্তিওয়ালার মশক কাঁধে রাস্তা ধোয়া। ভিস্তিরা বিভিন্ন ঐতিহাসিক যুদ্ধেও মশক কাঁধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যুদ্ধের মাঝেই তারা যোদ্ধাদের তৃষ্ণা নিবারণ করত। যে -কোনো ধর্মীয় উৎসব, অনুষ্ঠান বা সমাবেশে জল সরবরাহের দায়িত্বে থাকত ভিস্তিওয়ালারা। এক সময়ে এরা হাইকোর্ট, পুরসভাতেও জল সরবরাহের কাজ করত। কলকাতার বহুতলের ঘরে ঘরে রান্না আর স্নানের কাজে লাগত তাঁদের সরবরাহ করা জল। ১৯৪০-৫০ সাল পর্যন্ত কলকাতার কয়েকটি রাস্তা ধোয়ার কাজেও ভিস্তিওয়ালাদের জল কাজে লাগত। অন্যদিকে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ভিস্তিওয়ালারা ছিল ঢাকার রাস্তায়।

প্রাথমিকভাবে, তারা কোনো ধরনের পারিশ্রমিক ছাড়াই জল সরবরাহ করে দিত। কিন্তু পরিবর্তিত সময়ে তারা এটিকে আয়ের উৎস হিসেবে গ্রহণ করে। কঠোর পরিশ্রম সত্ত্বেও এটার জন্য তাদের বিনিময় মূল্য ছিল একেবারেই নগণ্য। চামড়ার ভারী মশকটি বহন করার জন্যও প্রচুর শক্তির প্রয়োজন হয়। কিন্তু আয় হতো সামান্যই।

আজকাল ট্রেনে বাসে রাস্তায় রেস্তোরাঁয় সর্বত্রই জল তেষ্টা পেলে আমাদের হাতে উঠে আসে সিল করা ঠান্ডা জলের বোতল। কিন্তু এই ফ্রিজ তো হাল আমলের। অনেকের মুখে শুনেছি, তখন ফ্রিজ না থাকলেও ছিল 'ভিস্তি'। ভিস্তি বা মশকে ফ্রিজের মতোই ঠান্ডা থাকত জল। মশক এমন এক ঐতিহাসিক পণ্য, যেটি সহস্রাব্দেরও বেশি সময় ধরে মশক কারিগররা দক্ষতার সঙ্গে তৈরি করে আসছে। ভিস্তিদের হাতে থাকা এই মশকগুলো মূলত ছাগলের আস্ত চামড়া দিয়ে তৈরি হয়। ছাগলের চামড়া গলা থেকে পায়ের অর্ধেক অব্দি ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। চামড়া থেকে দুর্গন্ধ এবং জীবাণু দূর করে চামড়াজাত করা হয়। প্রায় কুড়ি দিন জলে ভিজিয়ে রেখে শুকানোর পর একে জলরোধী করতে মহিষের চর্বি দিয়ে ঘষা হয়। তারপর মশক কারিগররা সাদা সুতোর সঙ্গে একধরনের বিশেষ মোম ব্যবহার করে গোটা চামড়ার পেট সেলাই করে, প্রস্তুত করে মশক। যা নিশ্চিতভাবেই জল-নিরোধক হয়। শুধু গলার কাছটা খোলা থাকে সেখান দিয়ে জল ভরা ও ঢালার জন্য।’
......................................................

‘ভিস্তি আবে ভিস্তি
মৌসুমী ঘোষ
.......................................
বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা
সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়

অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল

মুদ্রিত মূল্য : ৬৯০ টাকা

সুপ্রকাশ


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।