হাফ প্যাডেলের কাল।। অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামীর স্মৃতিকথন 'হাফ প্যাডেলের কাল' পড়ে পাঠ-প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন শাফিন মাসফিকুল আলম। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে আমরা নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি। 
অধিকাংশ ভালো বই আন্ডাররেটেড কেন, পাঠকের ভাবা প্রয়োজন।
............................................................................................................

এই লেখক কোথাও একবার লিখেছিলেন— শৈশব ও শৈশবোত্তর সময়ের কিছু কিছু স্মৃতি নিউরনের কোষে কোষে প্রস্ফুটিত ফুল হয়ে বসত করে। আজীবন সঙ্গী এই স্মৃতিমালার হাত থেকে নিস্তার পেতে মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় মানুষকে। তবে কিছুটা স্বস্তি মেলে যদি এগুলো অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায়।
হয়তো এ জন্যই তাঁর কলমে রচিত হয়েছে— হাফ প্যাডেলের কাল।
খুবই মায়াকাতর এই লেখা। লেখক অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী উপন্যাসের আঙ্গিকে লিখেছেন তাঁর বালক বয়সের কয়েক বছরের স্মৃতি।
সময়কাল ষাটের দশক। লেখক গ্রাম ভালুকখুল্যা থেকে দুর্গাপুর এসেছেন তাঁর দাদা গোস্বামীবাবুর কাছে থেকে স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হতে।
গোস্বামীবাবু চাকরি করেন ডিভিসি, এক সরকারি সংস্থায়, থাকেন এর জন্য নিযুক্ত কোয়ার্টারে। দাদা বিবাহিত, তবে বৌদি থাকেন বাপের বাড়ি, সাথে সদ্যোজাত কন্যা। দাদা কিছুদিনের ভেতর ওদেরও নিয়ে আসবেন।
পেশায় চাকরিজীবি, প্যাশনে ভলিবল খেলোয়ার দাদা গোস্বামীবাবু (এবং উপন্যাসে আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র) ছোট ভাইয়ের লেখাপড়ার প্রতি বেশ সংবেদনশীল। উপন্যাসে পুরোটা সময়কালে আমরা লেখক অর্দ্ধুর প্রতি দাদার কোমল-কঠোরতা মেশানো, আবেগ বিবর্জিত যে মমতা দেখতে পাই, পড়তে পড়তে বারবার মনে হচ্ছিল— যদি আমারও এমন একজন বড় ভাই থাকতো...যাক সে ভিন্ন কথা।

দাদা মর্নিং শিফটে কাজে চলে গেলে থেকে যায় তাঁর সেনর‍্যালে সাইকেল। লেখকের কাজ হচ্ছে দাদা বেরিয়ে গেলেই চুপিচুপি দাদার সাইকেল কোয়ার্টারের বারান্দা থেকে বের করে রাস্তা পেরিয়ে অদূরের শালবনে ঢুকে পড়া।

সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে অর্ধ্বু অনুভব করেন শীতের দুপুর। যেখানে ঝোপে ঝোপে পাখি লাফায়, ডেকে ওঠে কখনও কখনও। যেন বালকের সাইকেল চালনা দেখবে বলেই তারা অপেক্ষা করছে বলে মনে হয়। দেহের তুলনায় বড় সাইকেলটি ব্যবহারে মাঝে মাঝে বেগ পেতে হলেও থেমে থাকে না গতির উপর ভর করে সাইকেল ও শরীরকে আয়ত্তে আনার চেষ্টা।

শিয়াকুলের ঝোপে সাইকেল সহ উল্টে পড়ুক কিংবা হাতেপায়ে কাঁটার আঁচড় লাগুক, তবু যখন মাটি থেকে পা তুলে হ্যান্ডেলকে বশ মানিয়ে কিছুটা সময় ছুটে চলে বালক, দুটো অদৃশ্য ডানা গজায় যেন মনে। অর্দ্ধু যখন ছুটে চলে বনভূমির আঁকাবাঁকা বেপথ দিয়ে, এক অলৌকিক অনুভব যেন থাকে লেখকের বালক সত্তা জুড়ে।

কল্পনায় সাইকেল পাড়ি দেয় তার ফেলে আসা গ্রাম। দুর্গাপুরের বেঁটে বন এক নিমেষেই হয়ে যায় ভালুকখুন্যার জঙ্গল। লেখক অনুভব করেন— হলই বা হাফ, তবু জীবনের প্যাডেল এসে গেছে তার আয়ত্তে।
প্রায় ষাট বছর পিছিয়ে গিয়ে বালক থেকে কিশোরবেলার ছয় বছরের স্মৃতিকে তুলে এনেছেন লেখক। ধরেছেন তার মন-চিন্তা-আবেগ ও তার সরল সংস্কার। সেই সঙ্গে উঠে এসেছে সেই সময়কে আলোড়িত করা দেশবিদেশের ঘটনা, সেইসব মানুষ, যাদেরকে কেন্দ্র করে আব্রর্তিত হয়েছিল বালকের জীবন।

২৪৯ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটি ভীষণ রকমের আন্ডাররেটেড। আমি ব্যাক্তিগতভাবে রেকমেন্ড করি বইটা একবার হলেও সকল পাঠককে পড়ে দেখতে। বিশেষত সেই সব পাঠকদের, যারা বাংলা সাহিত্যে অকপট স্মৃতিকথা পড়তে চান। যেখানে নিজের স্খলন-পতনের এমন অর্গলহীন, দুঃসাহসিক বিবরণ প্রকৃতই দুর্লভ।

আমার পড়া লেখকের প্রথম বই। তাঁর আরও কিছু লেখা পড়ার আশা রাখি।
বইটি প্রকাশ করেছে সুপ্রকাশ। ভেতরে কিছু সুন্দর
অলংকরণ করেছেন অদ্বয় দত্ত। মূল্য ₹৩২২।

Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম।। অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। সুপ্রকাশ।।

চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে।। অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।