হাম প্যাডেলের কাল।। অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামীর বই 'হাফ প্যাডেলের কাল' পড়ে গুডরিডস্-এ মতামত জানিয়েছেন ফারজানা রহমান। আমরা নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
.................................................................
বই : হাফ প্যাডেলের কাল
লেখক : অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
প্রকাশনী : সুপ্রকাশ
মূল্য : ৩৫০ রূপী


ম্যাজিক মাশরুম।

শ্রুমস!

অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামীর 'হাফ প্যাডেলের কাল পড়ে এটাই মনে হলো— ম্যাজিক মাশরুম। এ এক অন্য ধরনের স্বচ্ছতা, অন্য জগতের ঘোর। ফেলে আসা সময়ের স্কেচ।

স্মৃতিকথা বা আত্মজৈবনিকমূলক লেখার উত্তম পুরুষের চেনা পাঠ থেকে পাশ কাটিয়ে লেখক যখন প্রথম পুরুষে বলে যান "আজন্ম খালিপদ পাড়াগেঁয়ে বালকটির" কথা— তখন ডটপেনে লেখা অদৃশ্য নাম সাদৃশ্য হয়ে ওঠে পাঠকের মনেও। প্রথম পুরুষে বয়ানের কারনেই এর রূপটি হয়ে ওঠে উপন্যাসের। বালকের সাদৃশ্যতা যে সরল ছকে ধরা দেবে পাঠকের সামনে, সেখানে হয়তো পার্সোনাল ম্যাগনেটিজম আরোপ হবে না, তবে বালকের সেই স্বচ্ছতাই ম্যাগনেটের মতো আঁকড়ে ধরবে পাঠককে।

"হাফ প্যাডেলের কাল" বর্তমান আর ফেলে আসা ছেলেবেলাম মাঝে ক্রমশ মিশে যাওয়া ক্লোজআপ। কাহিনির বালক মানে অর্দ্ধুর বালককাল আমাদের সমবয়সীই। তাই যেন আরও চেনা এবং ঠিক এ কারনেই এরকম এস্ট্রাল প্রোজেকসন নিজের মধ্যেই আলাদা জায়গা তৈরী করে নেয়। "হাফ প্যাডেলের কাল" সেই পালে প্রবল হাওয়া জোগায় বৈকি!

যদিও পাঠিকা বলে আমার হয়তো হাফ প্যাডেলের কাল ছিল না। ইনফ্যাক্ট সেই সময়ে সাইকেল ব্যাপারটা মেয়েদের জন্যে বা আগ্রহের সীমানায়ও ছিল না। সাইকেলটা যে সময়ে ধরেছি, ততদিনে আমার পা বৃদ্ধি পেয়ে মাটি খুব সহজেই ছুঁয়ে ফেলে। তবে এ দৃশ্য অচেনা না। ভাইয়ের বন্ধুদের, বা পাড়ার ভাইয়েদের কত দেখেছি হাফ প্যাডেলে নিতান্তই বালকসুলভ যু/দ্ধের প্রস্তুতি।

আমরা বাঙালি মাত্রেই নস্টালজিয়ার আরামদায়ক কুয়াশার ঘেরাটোপে নিজেরে ইমোশনটুকু উজাড় করে দেই। ভালো লাগে। অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামীর 'হাফ প্যাডেলের কাল' তাই আমাদের হৃদয়ের অনেকটা কাছে এসে জায়গা করে নেয়। প্রথম পুরুষে বয়ানের কারনে "বালক"-এর জায়গায় খুব সহজেই "বালিকা" অথবা "ফারজানা রহমান" কে স্থানান্তরিত করা যায়। খুব একটা বদলায়না কুয়াশায় মাখা দৃশ্যটুকু।

'হাফ প্যাডেলের কাল' রাস্তার দুপাশে হয়তো দু'রকম অক্ষর— স্মল আর ক্যাপিটাল, ভাওয়েল, কনসোনেন্ট, ভয়েস চেঞ্জ, ন্যারেশন— পাঠিকার ফেলে আসা চেনা রাস্তারই মতো। যদিও রাস্তার দুপাশের এগুলো নিয়ে বালকের মতো আমিও উদাসীন ছিলাম। ধূসর ধুলো মাখা রাস্তাটাই ছিল পৃথিবীর সব রঙ, রূপ।

আমার প্রার্থণাও ছিল জটিলতাবিহীন; সহজ, সরল, সাদাসিদে। টোটোবাজি— যা দখল করে নেয় শৈশবের পুরোটা। আমার প্রার্থণায় নিজের বা আপনজনদের দীর্ঘায়ু কামনা থেকে বরং একটা বিকেলের দীর্ঘায়ু কামনা ছিল বেশি জোরালো। প্রার্থনায় ছিল স্যারের হঠাৎ অসুখের অজুহাতে ক্লাস মিসের আশা। সকালে বৃষ্টির প্রার্থনার বিপরীতে বিকেলে বৃষ্টি না হবার প্রার্থনা।

'হাফ প্যাডেলের কাল'-এর শেষটা কিছুটা ট্রাজিক। গোস্বামীবাবু মনটাকে ভারাক্রান্ত করে। বালকের সেই ট্রাজিক মোমেন্ট অবশ্য আমার বালিকা বেলায় ফেস করিনি— পার্থক্য তো এটুকুই। অবশ্য সেই সময়ে "ট্রমা" এবং "ট্রাজিক" শব্দগুলোর সাথেই তো পরিচিত না। মানেও জানা নেই। পাঠিকা আরও অনেক অনেকগুলো বছর পেরিয়ে শব্দগুলোর স্বরূপ জানবে। যখন "গোস্বামীবাবু" কে প্রতিনিধি করবে তার নিজের "মা"।

ঠিক তারও অনেক বছর পরে বালিকা (পাঠিকা) অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামীর 'হাফ প্যাডেলের কাল' পড়ে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে বসে থাকবে। মনে মনে হয়তো বলবে— শ্রুমস!

অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামীর 'হাফ প্যাডেলের কাল' খুব সহজ-সরল শব্দে নস্টালজিয়ার আরামদায়ক কুয়াশার ঘেরাটোপে বেড়ে ওঠা সময়। স্পাইরাল ক্যালেন্ডারে তারিখ বেয়ে নেমে আসা স্মৃতির বরফকুচি।

Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম।। অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। সুপ্রকাশ।।

চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে।। অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।