বাঘাচাঁদের কথাকাব্য।। অনিল ঘোষ।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।
সুপ্রকাশ প্রকাশিত অনিল ঘোষের বই 'বাঘাচাঁদের কথাকাব্য' পড়ে 'আজ কাল পরশু, শারদ ২০২৫' পত্রিকায় আলোচনা করেছেন তপন কুমার মণ্ডল।
...................................................................................
বাঘাচাঁদের কথাকাব্য : ইতিহাস ও মিথের আশ্চর্য বিনির্মাণ
শুরুতেই চমক— “কার এঁজ্ঞে? বাঘাচাঁদের এঁজ্ঞে—"
মনে হল পঞ্চাশ বছর আগে কোনো এক বটতলায় বসে কোনো গল্পকথক বাঘাচাঁদের স্মরণ নিয়ে তার গল্পের ঝাঁপি খুলছেন। সুন্দরবনের গল্প।
সুন্দরবন অপার রহস্য ও বিস্ময়ের এক আশ্চর্য লীলাক্ষেত্র। বাঘ, কুমির, বাদাবন যেমন তার চিরায়ত চরিত্র, তেমনি বৈচিত্র্যময় তার জঙ্গল হাসিলের ইতিহাস, সামাজিক বিবর্তনের ইতিবৃত্ত এবং ভূখণ্ডের মানুষের সংঘর্ষবহুল জীবনযাত্রা। সুন্দরবন অনুভবের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে অনেক অনেক লোককথা, লোকবিশ্বাস ও কিংবদন্তী যা স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সুন্দরবনের জনপদ গঠন থেকে শুরু করে তার ও তার মানুষজনের বিবর্তনের নানা প্রসঙ্গের উদযাপন গোষ্ঠীগত,সামাজিক বা পারিবারিক আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে ধরা থাকে যার মধ্যে দিয়ে এক একটা কিংবদন্তীর জন্ম হয় এবং সেগুলি ধীরে ধীরে কাহিনি বা আখ্যানের রূপ লাভ করে। সেই আখ্যানের ভিতর জল জঙ্গলময় জীবনের লড়াই সংগ্রামের ছোটো বড়ো নানা কথা,মানুষের অতিমানবিক শৌর্য- বীর্য সাহসের কথা, বিভিন্ন দেবদেবী, পশুপাখি ইত্যাদি নানা জন ও নানা কিছুর উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। তার সবটাই যে ইতিহাস-স্বীকৃত এমন নয়, আবার পুরোটাই যে কল্পনা এমনটাও নয়।
সুন্দরবন নিয়ে কবি-লেখকদের আগ্রহের অন্ত নেই। সুপ্রাচীন কাল থেকে জল-জঙ্গল-সাপ-বাঘ-কুমির সংকুল সুন্দরবনের মানুষের প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকার গল্প নিয়ে রচিত হয়েছে কথাকাব্য-ছড়া, গান, আখ্যান। তার সঙ্গে একাধারে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস ও মিথ।সেই যৌথ অনুভবকে ধরে সেকালে যেমন মনসামঙ্গল, রায়মঙ্গল, শীতলামঙ্গল প্রভৃতি মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছে তেমনি একালেও কবি ও কথাসাহিত্যিকদের কলমের ছোঁয়ায় উঠে এসেছে চমকপ্রদ সব আখ্যান। এরকম একটি আখ্যান সম্প্রতি পাঠ করার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে।
বাঘাচাঁদের কথাকাব্য। নামের মধ্যেই বিষয় ও উপস্থাপনা দুটোরই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। প্রথমেই বিষয়। বাঘাচাঁদ একটি কাল্পনিক চরিত্র। সুন্দরবনের আকাশে বাতাসে ধূলিকণায় ভেসে বেড়ানো অজস্র কাল্পনিক গল্পকণায় তার নির্মাণ। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সুন্দরবনের জল-জঙ্গল-জমি-ভূমি-বাদাবনকে কেন্দ্র করে যে সকল মিথের উদ্ভব সেরকমই একটা মিথ হচ্ছে বাঘাচাঁদ। বাদার সাধারণ একজন অধিবাসী থেকে ঘটনা পরম্পরায় কীভাবে বাঘাচাঁদ একটা মিথিক্যাল চরিত্র হয়ে উঠল, তারই উপাখ্যান হয়ে উঠেছে বাঘাচাঁদের কথাকাব্য। এগারোটা পর্ব জুড়ে তার বিস্তৃতি।
কাহিনির কেন্দ্রবিন্দু হল বাঘাচাঁদ। তাঁকে স্মরণ করে আখ্যানের পথ চলা। জীবনধারণের তাগিদে বাঘ-শ্যাল-জিন-দানো সংকুল বাদার দেশে অগণিত মানুষের মতো বাপ-মা-ভাই-বোন সব খুইয়ে আকালের দেশ থেকে রাখহরি সর্দারের হাত ধরে আসে বাঘাচাঁদও। তার আসল নাম কেউ জানে না।দশাসই চেহারা, কালো পাথরের মতো শরীর, চওড়া বুকের ছাতি, তালগাছের মতো ঢ্যাঙা, বড়ো বড়ো চোখ আর কুচকুচে কালো চুলের অধিকারী সে।বাঘের ভয়ে ভীত বাদার মানুষদের কাছে বরাভয় হয়ে সে কুড়াল হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঘের উপরে এবং অপরিসীম বীরত্ব ও পরাক্রমে বাঘকে হত্যা করে হয়ে ওঠে বাঘাচাঁদ।
এক চোখে জল আর অন্য চোখে হাসি নিয়ে বাঘ মেরে বাঘাচাঁদ হয়ে ওঠে বাদাবনের পরিত্রাতা। বাদাবাসীর মুক্তিদূত। বাঘের ভয় তাড়িয়ে হয়ে উঠল তাদের রাজা।তাদের পুরোনো পরিচয় ভুলে, জাত-ধর্মের ভেদ ভুলে জমি হাসিল করে আবাদ গড়ার আহ্বান জানাল সোঁদরবনে।
বাঘাচাঁদের হাতে বাদার বাঘ নিকেশ হওয়ায় বাঘের ভয় ঘুচল। চারদিক থেকে মানুষের ঢ্ল নামল বাদার জীবনে। দূরের দেশ থেকে নতুন করে যারা এল তারা বাঘাচাঁদকে রাজা মানবে কেন? তার পরিধানে তো রাজার মতো জমকালো পোশাক নেই, নেই রাজাসন কিংবা রাজমুকুট। সঙ্গীদের আগ্রহে চলল রাজা হওয়ার প্রস্তুতি।
রাজা হতে গেলে রাজা সাজতে হয়। বাদায় রাজা হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেতে হয়। সাথীদের প্রবল ইচ্ছায় বাঘাচাঁদকে রাজার সাজে সাজানোর ব্যবস্থা হল। আচার আচরণ, কথা-বার্তা, হাবভাব, রীত-কিত বদলে বাদার রাজা মায় বাদার দেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আয়োজন চলল।
সবই তো হল। এবার তো রাজার একটা প্রাসাদ লাগবে। রাজা তো আর সাধারণ বাদাবাসীর মাঝখানে থাকতে পারে না। তাই লোকসাধারণের নাগালের বাইরে, কোলাহল থেকে দূরে জঙ্গল লাগোয়া তিন গাঙের মুখে যেখানে তিনদিকে জল আর একদিকে মাটির সংযোগ সেখানে নির্মিত হল গোলপাতার ছাউনি দেওয়া সুন্দরী-পশর-গরান-গেঁও কাঠের চমৎকার প্রাসাদবাড়ি। সেখানে রাজা হিসাবে অধিষ্ঠিত হল বাঘাচাঁদ। মাথায় পরানো হল সুন্দরী গেঁও আর গোলপাতার তৈরি রাজমুকুট। বসানো হল বাঘছালে মোড়া রাজাসনে।
তারপর ধুঁদুল গাছে ফুল ধরে, কোকিল ডাকে কুহু,ঘুঘু ডাকে কুরুর। বাঘাচাঁদের হৃদয়ে লাগে বসন্তের ছোঁয়া। শালিডাঙার রাজকন্যার প্রেমে পড়ে বাঘা।শালিডাঙার রাজার কাছে প্রস্তাব প্রেরিত হয় এবং যথারীতি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়। বাঘাচাঁদ যুদ্ধ ঘোষণা করে। যুদ্ধে শালিডাঙার রাজাকে বুঝিয়ে দেওয়া হল সোঁদরবনের রাজা বাঘাচাঁদকে উপেক্ষা করার পরিণাম। যুদ্ধ জয় তো হল, কিন্তু কোথায় সেই সুন্দরী কন্যা যার জন্য এত আয়োজন!
এক যুদ্ধ যেতে না যেতেই আর এক যুদ্ধের ইঙ্গিত। ভাইচারায় ভাগ বসাতে শিবতলিতে বহিরাগতদের আগমন হল। তাদের পীড়নে অতিষ্ঠ শিবতলির আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা ছুটল বাঘাচাঁদের কাছে। নিজের সঙ্গীসাথীরা উদাসীনতা ও অনীহা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত বাঘাচাঁদের কথায় যুদ্ধে গেল এবং রক্তপাতহীন যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাঘার জয় হল। কিন্তু বাঘার মন হল উচাটন।
এদিকে বাদাবনের ব্যাপক প্রসারে তার বিভিন্ন অংশের নাম নিয়ে অধিবাসীদের মধ্যে সংঘাত দেখা দিল। খুনোখুনি রক্তারক্তি পর্যন্ত গড়াল।বাঘাচাঁদের কৌশলে বিভিন্ন অঞ্চলের সার্থক নামকরণের মধ্যে দিয়ে সমস্যার সমাধান হল।
সময় গড়িয়ে যায় নিজের নিয়মে। বাঘাচাঁদ উপলব্ধি করে কোথাও একটা শৈথিল্য দেখা দিচ্ছে বাদার জীবনে। একদিন ভয় তাড়িয়ে বাদার বুকে নতুন প্রাণের জোয়ার এনেছিল যে বাঘা সে আজ বুঝতে পারে, বাদাজীবনে শনি ঢুকেছে। নিস্তার পেতে গেলে বাঘ থাকুক না থাকুক বাঘের ভয়টা অত্যন্ত জরুরি। তাই সুন্দরবনের কালো হলুদ ডোরাকাটা বাঘরাজার সঙ্গে আপস করে বাঘাচাঁদ।
ধীরে ধীরে বাঘা টের পায় যারা তাকে জোর করে রাজা বানিয়েছে, তাকে প্রসাদবন্দী করেছে, সাধারণ মানুষের থেকে আড়ালে রেখেছে তারাই আজ বাঘার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। তারাই আজ বাদাবনের ঐতিহ্য ধ্বংস করে আধুনিক নগর সভ্যতার অনুপ্রবেশ ঘটাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এভাবেই বাঘার মহিমা ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত বাঘাচাঁদ ধ্বংস হয়, জেগে থাকে তার নামের মিথ।
বাঘাচাঁদের কথাকাব্য শুধু বাঘাচাঁদের কথাই বলে না, বলে সুন্দরবনের জল জঙ্গলের কথা,হাভাতে মানুষের ভাতের স্বপ্ন নিয়ে বাদার মাটিতে পা রাখার কথা, জঙ্গল হাসিল করে আবাদ করার কথা, জলে কুমির ডাঙায় বাঘ শ্যাল জিন দানোর কথা, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের কথা, আবাদে মানুষের জমি-ভূমি কেন্দ্রিক লড়াই সংগ্রাম, রীতিনীতির কথা। এত কথার ভিড়েও যে কথাটি হারিয়ে যায় না সেটা হচ্ছে আখ্যানের রাজনৈতিক চরিত্র। গোটা কাহিনি জুড়ে বাঘাচাঁদের স্তুব-স্তুতি, বাদার মানুষের নিজেদের প্রয়োজনে তাকে রাজা সাজানো যা আসলে একটা আবরণ মাত্র, রাজা হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেওয়া, তার নামে সাঙ্গোপাঙ্গদের বাদা শাসন, শোষণ, প্রাসাদে মৌরসীপাট্টা গেড়ে ফেলা,তাকে আড়াল করে উন্নতির নামে সঙ্গীদের বাইরের জমি হাঙরদের বাদার জমিন কেড়ে নেওয়ায় মদতদান, ধানি জমিতে লোনাজল ঢুকিয়ে মেছোঘেরি বানানো— এসবের মধ্যে কি আজকের চাটুকারসর্বস্ব অথচ দখলদারি রাজনীতির ছায়াপাত ঘটেনি?
আবার, বাঘাচাঁদকে কাঠের পুতুল করে তার চারদিকে একটা অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিয়ে তাকে সাধারণের সংশ্রব থেকে দূরে রাখা, বাদার মানুষের জন্য যে রাজাসনে বসা সেই আসনের একদিন তাকেই গ্রাস করে নেওয়া, বাদার ভবিষ্যৎ নিয়ে সেকাল আর একালের সংঘাতে নিজের নিয়মের জালে নিজেই বন্দী বাঘার বিপর্যস্ত অবস্থা কি আমাদের রক্তকরবীর রাজার কথা মনে করায় না, যেখানে যক্ষপুরের ঘেরাটোপে অবরুদ্ধ রাজার মুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়! সময়ান্তরে মুক্তির আহ্বানে সাড়া দিয়ে রক্তকরবীর রাজা যেমন নিজেই নিজের বেড়াজাল ছিন্ন করে বেরিয়ে পড়েন,আমাদের বাঘাচাঁদও তেমনি নতুনের আহ্বানে নিজের মহিমাজাল ছিন্ন করে ঠুনকো রাজাভিজাত্যের মোহজাল বিদীর্ণ করে নিজের তৈরি বদ নিয়মের প্রাসাদ ভেঙে চুরমার করে নতুন আলোতে যে মুক্তি নিজের জীবন দিয়ে তাকেই যেন সার্থক করে যায়।
এবার আসি,আঙ্গিক নির্মাণ প্রসঙ্গে। উপন্যাসে লোক আখ্যানের আঙ্গিক অনুসৃত হয়েছে গ্রন্থের ব্লার্বে এমনটাই দাবি করেছেন লেখক। বস্তুত সুন্দরবনের গ্রাম-গঞ্জে থান জাগানো গান, যা আসলে জাগ গান নামে পরিচিত সেই গানের আঙ্গিক অনুসারে কেউ কেউ কথক হয়ে এক একটা ঘটনার উল্লেখ করে যেত, কেউবা এক-একটা চরিত্র হয়ে নাচ-গান-অভিনয়ের মাধ্যমে কাহিনি পরিবেশন করত। আখ্যান-কথকের ভূমিকা নিয়ে কথায়-ছড়ায়-গানে আখ্যানকে পাঠক কিংবা শ্রোতা কিংবা দর্শকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করত তারা।লোক কাহিনির এই উপস্থাপন রীতি যথাযথভাবে প্রযুক্ত হয়েছে এখানে।
সৌজন্য চক্রবর্তীর চমৎকার প্রচ্ছদ এবং বিষয় বিন্যাসের সাযুজ্যে অদ্বয় দত্তের অসাধারণ অলংকরণ গ্রন্থের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করেছে। তবে স্থানে স্থানে একই ধরনের বাকনির্মিতির পুনর্ব্যবহার এবং কতিপয় বাক্যবন্ধের পুনরাবৃত্তি গ্রন্থের মর্যাদার পক্ষে কিঞ্চিৎ হানিকর হয়েছে।
..................................................
বাঘাচাঁদের কথাকাব্য
অনিল ঘোষ
সুপ্রকাশ
মুদ্রিত মূল্য : ৩০০ টাকা
Comments
Post a Comment