সৌভাগ্যশলাকা।। অলোক সান্যাল।। সুপ্রকাশ

করোটি পাহাড়ে উঠে আসার মুখে, একটা পাথরে নিজের ভর সঁপে বসে ছিল গায়াস। তার সেনা-পোশাকে লেগে থাকা রক্তের দাগ শুকিয়ে গাঢ় হয়েছে। গতকালের ভিড় অদৃশ্য হয়েছিল সন্ধের আগেই। তারপর থেকে ক্রুশবিদ্ধ শরীরগুলো পালা করে পাহারা দিয়ে গেছে অধীনস্থ সামারিটান সৈন্যরা। ক্লান্ত ছিল তারাও। আটদিন ধরে চলা নিস্তারপর্বে শহরে বহু পুণ্যার্থীদের আসা যাওয়া লেগে থাকে। সেই সময় শৃঙ্খলা রক্ষা করতে কম শক্তিক্ষয় হয় না। নিস্তারপর্ব মিটতে না মিটতেই আবার বিচারসভা বসেছিল। সে-ও এক অশান্তির পরিবেশ। আর তারপর গতকালের অস্থিরতা। সবকিছু সামলানোর পরে একটু বিশ্রাম তাদেরও প্রাপ্য।

এক রোমান সেঞ্চুরিয়ানকে করোটি পাহাড়ের মুখে উঠে আসতে দেখে নিজের ভাবনা থেকে সরে এল গায়াস। একটু দূরেই গভর্নর পিলেতের ব্যক্তিগত সচিব ম্যালিনাস উদাস মুখে দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি বাঁধা পড়ে রয়েছে ক্রুশবিদ্ধ নাজরাতীয় জিশুর নিষ্প্রাণ শরীরে। ম্যালিনাসকে আগে কখনো এতটা বিচলিত হতে দেখেনি গায়াস। বিচার শেষে এমন পরিণতি নতুন নয়। গলগাথার রাস্তায় এমন সারিবদ্ধ ক্রুশের অবস্থিতি বিষণ্ণতা এবং ভয় মিশ্রিত এক ধরনের অতীন্দ্রিয় অনুভূতির জন্ম দেয় বটে, তবে তা সাধারণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সেক্রেটারি ম্যালিনাস, সেঞ্চুরিয়ান গায়াস কিংবা সামারিটান সৈন্যদল, যারা বিশ্রামে গিয়েছে তাদের কাছে এ এক অতিপরিচিত স্বাভাবিক দৃশ্য। অথচ গভর্নরের ব্যক্তিগত সচিবটি গতকাল থেকে একই কথা আউড়ে চলেছেন,

'আমরা পাপ করেছি, গায়াস! নাজরাতীয় জিশু প্রকৃতপক্ষেই স্বর্গপ্রেরিত দেবদূত। সে ঈশ্বরের সন্তান। আমরা তার প্রতি অবিচার করেছি!'

গায়াস এতদিন ক্রুশে ঝুলন্ত শরীরটাকে মানুষ বলেই মনে করত। জ্ঞানী, বুদ্ধিমান এবং অবশ্যই, দয়ালু একজন মানুষ। দুঃখী মানুষের ব্যাধি জাদু প্রয়োগ করে দূর করতে দেখছে। গায়াসের নিজের ভৃত্যকেই সুস্থ করেছিল নাজরাতীয় জিশু। সেসবে বাকি ভক্তের দল ঐশ্বরিক ক্ষমতা খুঁজে পেলেও, গায়াস পেয়েছিল কৌশল। বিভিন্ন জমায়েতে তার বলা প্রতিটি কথা মন দিয়ে শুনেছে। টিলার উপরে দাঁড়িয়ে শ্যামলকান্তি মানুষটি উজ্জ্বল দৃষ্টি মেলে বলছে, 'আত্মায় নম্র যারা, তারা ধন্য। স্বর্গরাজ্য তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। যারা ন্যায়পরায়ণতার জন্য ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত, ধন্য তারা।' কিংবা, 'শত্রু যদি তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে চায়, বিচারসভা পৌঁছোনোর আগেই তার সঙ্গে মিটমাট করে নাও। নইলে সে তোমাকে বিচারকের হাতে তুলে দেবে, বিচারক রক্ষীর হাতে এবং রক্ষী তোমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করবে। মনে রেখো, নরহত্যা করলে ঈশ্বরের বিচারালয়ে জবাবদিহি করতে হবে।'

সত্যকে কত সহজভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল মানুষটা! অথচ দেখো, সকলে মিলে তাকেই কীভাবে অবলীলায় হত্যা করল! হ্যাঁ, নাজরাতীয় জিশুকে যে হত্যাই করা হয়েছে এ নিয়ে গায়াসের মনে অন্তত কোনো সংশয় নেই। হয়তো সচিব ম্যালিনাসও তা-ই মনে করেন। বিচারের নামে হত্যা। আর সে, সচিব ম্যালিনাস, সামারিটান সৈন্যদের দল, এবং অবশ্যই গভর্নর পিলেত সকলে সেই পাপের সমান অংশীদার। বাকিদের সঙ্গে নরকের আগুনে তাদেরও পুড়ে মরতে হবে। কিন্তু এতকিছুর পরেও নাজরাতীয় জিশুকে কেবলমাত্র একজন জ্ঞানী মানুষ বলেই মনে করত গায়াস। গতকাল থেকে সেই ধারণা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। সচিব ম্যালিনাসের মতো তার মনও দ্বিধাদীর্ণ। সীমাহীন শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করেও কোনো মানুষ এতটা শান্ত, সমাহিত ভাব ধরে রাখে কীভাবে? আর তারপর, ক্রুশবিদ্ধকরণের সময় হঠাৎ নেমে আসা অকাল রাত্রি, পৃথিবীর কেঁপে ওঠা- এগুলো তো কোনো জাদুকৌশল ছিল না! তবে কি সত্যিই...? প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আশায় সচিব ম্যালিনাসের পাশে গিয়ে দাঁড়াল গায়াস। চোখাচোখি হতে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানাল।

'এই অহেতুক রক্তপাত এড়াতে গভর্নর সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। তা-ই না? তবুও দেখুন, মাননীয় ম্যালিনাস, আমাদের হাতে লেগে থাকা রক্তের দাগ অমলিন!'
.........................................
সৌভাগ্যশলাকা
অলোক সান্যাল

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত 

মুদ্রিত মূল্য : ৪৫০ টাকা

সুপ্রকাশ প্রকাশিতব্য। আগামী সপ্তাহে আসছে। 

Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম।। অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। সুপ্রকাশ।।

চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে।। অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।