কান পেতে রই।। অলক চট্টোপাধ্যায়।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত অলক চট্টোপাধ্যায়ের বই 'কান পেতে রই' পড়ে মতামত জানিয়েছেন প্রীতম ঘোষ। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
................................................................
#না_শেষ_হওয়া_গানের_ইতিহাস

বাংলা ও বাঙালির চরম খাওয়া-খাওয়ির মধ্যে, যেটা আমার মতো খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষকে একটু বেঁচে থাকতে, মন ভালো রাখতে ও এগিয়ে যেতে সাহায্য করে সেটা হল গান। আরও ভালো করে বললে বাংলা গান। বিভিন্ন শিল্পীর গাওয়া বাংলা গান তার গীতিকার, সুরকার একটা ইতিহাসের মতো বিষয়।

যেমন এখন যে গানটা এখন রেডিওতে চলছে সেটা হল— "এতো সুর আর এতো গান"— গেয়েছেন সুবীর সেন। সুরকার ও গীতিকার হিসাবে কাজ করেছেন সুধীন দাশগুপ্ত।  ঠিক তারপরের গানটিই হল— 'ঐ উজ্জ্বল দিন'— এই গানটিও কিন্তু সুবীর সেনের-ই গাওয়া। এই সকল গায়ক, সুরকার, গীতিকার কিন্তু বাংলা ও বাংলার সংস্কৃতিকে বয়ে নিয়ে চলেছেন এখনো, নিঃশব্দে কোনো মারামারি-হাতাহাতি ছাড়াই, হয়তো সেটা সবার চোখের  আড়ালেই।

https://youtu.be/Mwp-ULGjP8c?si=CtJoB9NcY3Rk4uzz

https://youtu.be/5-cB0AJ7so0?si=Jxo4tmNoRBIiMRgR

যেমন ধরুন মোহন চন্দ্র ঘোষ বলে থাকেন— " শোন বান্টু কিশোর কুমার যদি আর ১০ বচ্ছর বাইচা থাকতো, তাহলেই অনেক গায়ক ভিক্ষা কইরা খাইতো"। আমার বাপের মতো বাঙালীর বাংলারে নিয়ে গর্ব করার মতো একটা গোটা কিশোর কুমার আছে, ছিল বা থেকে যাবে।
শুধু একটা গানের কথা না বললেই না, চারুলতা
সিনেমার একটা বিখ্যাত রবীন্দ্র সঙ্গীত—
"আমি চিনি গো চিনি চিনি তো তোমারে ওগো বিদেশিনী"।

https://youtu.be/lsDYR6LiY2Y?si=cffI06u09kc6nc75

আসলে বাংলা বা বাঙালির যে সম্পদ তার গানে আছে সেটা হয়তো এখন বাঙালী অনুভব করেন না। বা আরেকটা জাতের কাছে এই সম্পদ আছে কিনা সন্দেহ আছে।

আবার ধরুন পল্লীকবি জসীমউদ্দিন লিখে ফেললেন দুটো গান— 'রঙ্গীলা রঙ্গীলা, রঙ্গীলা রে' অন্যটি হল 'নিশীথে যাইও ফুলবনে'— এই দুটো গান-ই গেয়ে পপুলার করে ফেললেন শচীন কত্তা (যতো দূর জানা সম্ভবত জসীমউদ্দিনের লেখা এই দুটি গান শচীন দেব বর্মন গেয়েছিলেন ওনার সঙ্গীত জীবনে।)

https://youtu.be/tf97tGEsTww?si=mLjT8WUSon_rG4N9

https://youtu.be/6FoCKbtUTRM?si=x6jn_NiWPO1PZxqu

আবার বাংলার সংস্কৃতিকে শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন কোনো টানাহেঁচড়া ছাড়া শুধু সুরের মাধ্যমে, তারাপদ চক্রবর্তীর মতো রাগসঙ্গীত শিল্পী, জন্মসুত্রে উনি ছিলেন ফরিদপুরের। হয়তো বাংলা ও বাঙালীর খাওয়া-খাওয়ির মধ্যে অনেক ছেলে ছোকরা, জ্ঞানী বা মহাজ্ঞানীরা ওঁর গান শোনা তো দূরের কথা নামটাও শোনেন নি।

https://youtu.be/nMqnylga9Do?si=MPlULeCpnIOtoMSW

ঠিক তেমনি বিখ্যাত ঝুমুরিয়া শিল্পী সুভাষ চক্রবর্তীকে হয়তো বিখ্যাত হওয়া অনেকেই দেখেন নি বা ওঁর গাওয়া 'লাল পাহাড়ি দেশে যা' গানটা দাঁত কেলিয়ে গেয়ে যাওয়ার পরও ওঁর কথা জানতেন না অনেক বাঙালী। গানটা লিখেছিলেন কবি অরুন চক্রবর্তী আর প্রথম রেকর্ড করেছিলেন সুভাষ চক্রবর্তী।

https://youtu.be/boFZR3BM11U?si=kg0_6NcxmAyjusqC

আরও একজন মানুষের কথা না বললেই নয়, অন্তত আজকের সময়ের জন্য খুব প্রাসঙ্গিক— তার নাম শাহ আব্দুল করিম। শাহ আব্দুল করিম ছিলেন সিলেটের  সুনামগঞ্জের মানুষ। একাধারে তিনি গান লিখেছেন, সুর দিয়েছেন, সেই গান গেয়েছেন ও গান শিখিয়েছেন। ওঁর লেখা একটা বিখ্যাত গান 'তোমারা কুঞ্জ সাজাও গো, আজ আমার প্রাননাথ আসিতে পারে', বেশিরভাগ সময় রাধাকৃষ্ণের প্রেমের বর্ণনা করার সময় এই পদটি গাওয়া হয়। ভাবুন শাহ আব্দুল করিম কতো কতো সহজে গান টা লিখে গেছেন।

https://youtu.be/5OZHHm2bqFY?si=Z_x21G6C7iuQJvul

আরও একটা বিখ্যাত গানের সম্পর্কে  কয়েকটি কথা একটু বলা দরকার। সেটি হল 'থাকিলে ডোবাখান, হবে কচুরি পানা'— এই গান টা স্বপন বসুর গলায় বহুবার শুনেছি, বহুবার। গানটি লেখা হয়েছিল বাগমারী দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে। লিখেছিলেন গুরুদাস পাল। হিন্দু ও পাঞ্জাবীদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায় যায় এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়ে উনি লিখে ফেলেছিলেন এই গান টা। আসলে এই গান টা গাওয়ার সময় খুব মূল্যবান কয়েক লাইন বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। মানুষ বলুন আর শিল্পীই বলুন তার নিজের প্রয়োজন মতো লাইন চারটে বাদ দিয়ে গানটা গেয়েছেন। ধান্দাবাজ বাঙালী তেমন জোর করে না জানালে এই তথ্য জানতে চায়ও না।

সেই চার লাইন হল—

জমিদারের স্বভাব করে চাষীর সর্বনাশ
আর খাতা ব্যবসায়ীদের স্বভাব খোঁজে চৈত্র মাস
আর ধনীর স্বভাব গরীব মারার কলকাঠি বানায়
ওরা বিভেদ-বিদ্বেষ-আগুন লয়ে খেলছে এই বাংলায়।
সেদিন ওই বাঘমারীতে হিন্দু আর পাঞ্জাবীতে  
ছিল লাগ লাগ লাগ লাগিয়ে দিতে চিত্তেতে বাসনা
স্বভাব তো কখনো যাবে না!
ও মরি,স্বভাব তো কখনও যাবে না!

https://youtu.be/We9u8pgfjNk?si=FHtk9oatHFGoocQo

আবার ধরুন অখিলবন্ধু ঘোষের 'যেনো কিছু মনে করো না' এই গানটি সবাই মোটামুটি শুনেছি। গানটি লিখেছেন পুলক বন্দোপাধ্যায় আর সুর দিয়েছেন  অখিলবন্ধু ঘোষের স্ত্রী দীপালি ঘোষ।

https://youtu.be/b6O3DcMK8YI?si=2pb_gxlu76iVhpBt

আবার ঠিক যদি শচীন দেব বর্মনের ক্ষেত্রেও দেখেন  মিরা দেববর্মন শচীন দেববর্মনের স্ত্রী সাবলীল ভাবে লিখে ফেলেছিলেন বিখ্যাত সব গান। যেমন—

'বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে।'
https://youtu.be/z9Int8aCxDs?si=yEl_2JiQZvJQcSGu

'শোনো গো দখিনো হাওয়া।'
https://youtu.be/2prZz54mn3k?si=7_WdlnBKhwgqnyhY

এরকম মানুষ যাঁরা মারামারি চুলাচুলি না করে বাংলা আর বাঙালী সত্ত্বাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, তাদের অনেকের খবরই হয়তো উত্তেজিত বাঙালী জানেন না বা রাখেন না।

সলিল চৌধুরী থেকে হেমাঙ্গ বিশ্বাস— একের পর এক বড়ো নাম— ঠিক একটা ফুটবল-ক্রিকেট টিমের মতো। একের পর এক বিখ্যাত গায়ক এসেছেন, তাঁদের সৃষ্টি মানুষের মধ্যে রেখেছেন। মানুষ কতো টা কদর করেছেন সে বিচার অন্য সময় হবে অথবা অন্য আলোচনার বিষয়। কিন্তু যে সৃষ্টি করে দিয়ে গেছেন তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকাটা আমাদের সভ্যতার মধ্যে পড়ে। যদিও আমরা অসভ্য একটা জাত— যারা সব ইতিহাস-ভূগোল ভুলে মেরে দিতে পারে শুধুমাত্র হুজুগের বসে।

যেমন ধরা যাক মান্না দের গান— 'ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে', গীতিকার ডি.এল.রায়। ঠিক একই গান মান্না দের কাকা কৃষ্ণ চন্দ্র দে গেয়েছেন। বাঙালী এই এই গানের লাইন ঝেড়ে সেই লাইন নতুন গানের মাঝে বসিয়ে একটা রিমেক করেছে, কিন্তু মান্না দের আগে মান্না দের কাকার গলায় গান টা কতো জন শুনেছেন সে নিয়ে সন্দেহ আছে।

https://youtu.be/Br-7mlxJkes?si=joLBg7BxPREQpXoB

কতোজন বাঙালী বলুন তো গগন হরকরা কে চেনেন যাঁর গানের সুরে অনুপ্রাণিত হয়ে একটা দেশের গান সুর করে ফেলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

https://youtu.be/XdohEp7JMxs?si=Zj1bVswaF0M_Z9c1

https://youtu.be/e-5YB1V9Grw?si=wIESDcwQgePD-kTx

আসলে আমাদের জানা বা শোনার পরিধি বরাবরই খুব কম। আমার বন্ধু বলে— 'আমরা জানি কম চিল্লাই বেশি।' চিল্লাইনা বাঙালির রক্তে গান আছে, গান দিয়ে একটা জাতিকে জাস্ট ঢেকে দিতে পারি আমরা। পরিধি ছোট হওয়ার যুগে মাঠ বড়ো খেলার একটা অস্ত্র হল বাংলা গান।

তাই 'গান হোক, সবাই সমান হোক'...

অনেক অনেক পড়তে হয়, না পড়লে নাকি জানার পরিধি কমতে থাকে। কুপমন্ডুক হয়ে যায় মানুষ। তাই সেই ভয় থেকেই বইয়ের পর বই পড়ে যেতে হয়। হয়তো আরও নতুন কিছু জানা যাবে, আরও একটু নতুন কিছু...

অনেক আশা নিয়ে বইটা পড়তে বসেছিলাম, হতাশ করে নি আমার মতো মুর্খ মানুষকে। সমৃদ্ধ হয়েছি অনেকটা, যতটা লিখে বোঝাতে পারলাম না শুধু তৃপ্তি টুকু থেকে গেল— ঠিক ততটাই। জ্ঞানের মাঠকে পরিধিতে বাড়াতে 'কান পেতে রই' একটা অস্ত্র হয়ে থেকে গেল।

বই : কান পেতে রই
লেখক : অলক চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশনা : সুপ্রকাশ প্রকাশনা
মুদ্রিত মূল্য : ৪৪০ টাকা

Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম।। অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। সুপ্রকাশ।।

চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে।। অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।