চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে।। অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।।

গোরিলা শিকার আটকাতে ভিরুঙ্গা ঘুরে ঘুরে অ্যান্টিলোপ শিকারের ফাঁদ ধ্বংস করতেন ডায়ান এবং তাঁর গোরিলা ট্র্যাকার দল। ১৯৬৭-তে রুয়ান্ডায় ২০টি দলে ঘুরে বেড়ানো ২৪০টি পার্বত্য গোরিলার এক একটা দলকে নেতৃত্ব দিত বিশালাকার সিলভারব্যাক গোরিলা। ১৯৭৭-এর শেষে ডায়ানের প্রিয়তম সিলভারব্যাক বারো বছরের ডিজিট-এর মাথা ও দুহাত কাটা শরীর আবিষ্কার করেন ডায়ানের সহকর্মী ইয়ান রেডমন্ড। ওয়াল্টার কঙ্ক্রাইটের সিবিএস ইভনিং নিউজ রিপোর্টে ১৯৭৭-এর ৩১ ডিসেম্বর ডিজিটের মৃত্যুর খবর বেরোলে গোরিলা সংরক্ষণে টনক নড়ে বাইরের পৃথিবীর। ১৯৭৮-এ চোরাশিকারি এবং ভিরুঙ্গা পার্কের আধিকারিকদের একটি দল শিশু গোরিলা কোয়েলিকে নিয়ে যেতে এলে সন্তানকে বাঁচাতে গিয়ে নিহত হয় ডিজিটের 'গ্রুপ ফোর'-এর আরেক সিলভারব্যাক আঙ্কল বার্ট, সঙ্গে ওই একই আক্রমণে শেষ হয় কোয়েলির মা ম্যাকো। কোনওক্রমে কোয়েলি বেঁচে গেলেও শিকারিদের গুলিতে আঘাত পেয়ে তিন মাসের মধ্যে গ্যাংগ্রিনে চলে যায় সেও। একের পর এক প্রিয় সঙ্গীর মৃত্যুতে অবসাদগ্রস্ত, নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, ধূমপানে আসক্ত হয়ে পড়া ডায়ান গোরিলা-গবেষণা থেকে সরে গিয়ে ক্রমশ একমুখী চোরাশিকার-বিরোধিতাকে লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিলেন। ডিজিট চলে যাওয়ার পর তৈরি হওয়া 'ডিজিট ফান্ড' (বর্তমানে 'ডায়ান ফসে গোরিলাজ ফান্ড')-এ আসা অর্থ দিয়ে ১৯৭৯ সালের চার মাসে মাত্র চারজন কর্মী নিয়ে মোট ৯৮৭টি অ্যান্টিলোপ ফাঁদ ধ্বংস করেন ডায়ান, আশ্চর্য, ঠিক ওই সময় ভিরুঙ্গা পার্কের ২৪জন কর্মীর নিজস্ব দল একটিও ফাঁদের নাগাল পায়নি। ডিজিট-হত্যা প্রসঙ্গে স্মৃতিকথা 'গোরিলাজ ইন দ্য মিস্ট'-এ ডায়ান লিখছেন— 'ফ্রম দ্যাট মোমেন্ট অন, আই কেম টু লিভ উইদিন অ্যান ইনসুলেটেড পার্ট অফ মাইসেলফ'। স্থানীয় এক শিকারির পুত্রসন্তানকে অপহরণ, গোরিলা মল জোর করে খাইয়ে শিকারিদের সেপ্টিসেমিয়ায় আক্রান্ত করার চেষ্টা, কালো জাদুর মতো সংস্কারাচ্ছন্ন বিষয়ে ঝুঁকে পড়া— এইসমস্তই কথিত হয়ে আছে শেষ কয়েকবছরের ডায়ানের সঙ্গে। এই সত্যি কিংবা অতিকথনের ভেতর, ডায়ান ফসে পাল্টে যাচ্ছেন ক্রমশ। বন্ধুহীন, শৈশব-কৈশোরবিহীন ডায়ান, কাদামাটির রুয়ান্ডা পাহাড়ে ওঠা, এম্ফাইসিমা আক্রান্ত ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়া ডায়ান, কঙ্গোয় সৈন্যশিবিরের অন্ধকার ইতিহাস নিয়ে খিটখিটে, চিন্তিত ডায়ান ফসে কারণে অকারণে স্থানীয় আফ্রিকানদের ওপর বিরক্ত হয়ে পড়ছিলেন। ক্রিসমাস উপহার দিয়ে ঠিক পরমুহূর্তেই তাদের ছোট ছোট ভুলে চিৎকার করে উঠছেন—পরোক্ষভাবে হয়তো ঔপনিবেশিক, বর্ণবিদ্বেষ মানসিকতার প্রকাশভঙ্গি এসে যাচ্ছে তাঁর ওপর। শখের পর্যটক তকমায় এঁটে দিয়ে, ষড়যন্ত্রের অভিযোগে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করলেন কারিসোকে রিসার্চ সেন্টারে আসা তরুণ গবেষকদের। পাশাপাশি রুয়ান্ডা সরকার এবং ভিরুঙ্গা পার্ক সংস্থা ওআরটিপিএন-এর পর্যটন প্রচারকে গোরিলা-বিরোধী বলে সরাসরি বিরোধে নামলেন। মনুষ্যজনিত অসুখ গোরিলায় সংক্রামিত হয়ে যাওয়ার ভয় পেলেন, পাশাপাশি পড়শি দেশ জাইরের গোরিলাদের আচরণ দেখতে উল্লাস করে ভিড় করা পর্যটকদের ডায়ান চিনে নিয়েছিলেন আগেই। একবারের জন্যেও অ্যান্টিলোপ ফাঁদে হাত না দেওয়া অভিজাত মার্কিন-ইউরোপীয় শৌখিন সংরক্ষণবাদীদের আক্রমণ করতে থাকলেন। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত গবেষণার জন্য ইথাকায় ফিরে আসা এবং শেষ দু' বছর আবার সেই আফ্রিকায় থাকা ডায়ান হয়ে গেছেন আরও গৃহবন্দী। নিজস্ব কর্মী, গবেষক প্রত্যেকে ভয়ে, বিরক্তিতে এড়িয়ে চলছেন ডায়ানকে। ১৯৮৫-র ২৭ ডিসেম্বর ভোর সাড়ে ছ'টায় পরিচারক এবং এক সহকর্মী-ছাত্র প্রায় তছনছ হয়ে যাওয়া নিজস্ব কেবিনের ভেতর মাথায় কোণাকুণি একটি ধারালো অস্ত্রের আঘাতে শেষ হয়ে যাওয়া বছর চুয়ান্নর ডায়ান ফসের নিঃস্পন্দ শরীর খুঁজে পান। ডায়ানের একসময়ের পরিচিত, পরে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাওয়া গবেষক বিল ওয়েবার বলেছেন— "শি ডিডন্ট গেট কিল্ড বিকজ শি ওয়াজ সেভিং দ্য গোরিলা'জ, শি গট কিল্ড বিকজ শি ওয়াজ বিহেভিং লাইক ডায়ান ফসে।"

আসবাব দিয়ে ঠাসা গোটা কেবিনে মাত্র একটি ফাঁকা জায়গা ছিল আর সেখানেই সিঁদ কাঁটা হয় ২৬ ডিসেম্বর রাতে। তাহলে কি ডায়ানের পরিচিতদের কেউ? আমৃত্যু শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থাকা, হিংসের ধারেকাছে না থাকা, রুয়ান্ডার উপজাতিদের চরিত্রের সঙ্গে কোনওভাবেই এই পরিকল্পিত বীভৎস হত্যা আসে কি? বিদেশি কেউ? দোষী ধরা পড়েননি। আনুমানিকভাবে কেউ কেউ চিহ্নিত হয়েছেন মাত্র। বাহুটু-বাটওয়া চোরাশিকারি দল, আঠারো বছর আগে কঙ্গোর রুমাঙ্গাবো ক্যাম্পে বন্দী থাকাকালীন ডায়ানের কৌশলে উগান্ডা সরকারের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া কঙ্গো বিদ্রোহী সেনাদের কেউ, কারিসোকে দখলের উদ্দেশে থাকা রুয়ান্ডা সরকার বা ভিরুঙ্গা পার্কের আধিকারিকদের ভেতর এক বা একাধিক ব্যক্তি, ডায়ানের নিজের বহু মূল্যবান নোট পেয়ে গবেষণা শেষ করার লোভে থাকা কারিসোকের গোরিলা-গবেষণা দলের কেউ—নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়নি কাউকেই। রুয়ান্ডা সরকার থেকে ডায়ানের এক ছাত্রকে সরাসরি অভিযুক্ত করা হয়, যদিও সেই ছাত্রের পক্ষ থেকে ক্রমাগত অস্বীকার এবং যথেষ্ট প্রমাণের ওভাবে ডায়ান হত্যা মামলা অমীমাংসিত হয়েই থেকে গেছে। শুধু আশ্চর্য প্রাসঙ্গিক হ্যাগেনিয়া বা হাইপেরিকাম গাছে ঘেরা কাদামাটির কারিসোকেতে স্থানীয়দের ভাষায় 'নাইরামাকিবিলি' বা 'দ্য লেডি হু লিভস অ্যালোন ইন দ্য ফরেস্ট' নামে কিংবদন্তি হয়ে থাকা ডায়ান ফসের সমাধিতে লেখা কথাগুলো—'গোরিলাদের আর কেউ এতটা ভালোবাসেনি, শান্তিতে ঘুমোও, প্রিয় বন্ধু'।
..........................................................
চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে
(পরিবেশ সম্পর্কিত আক্রমণ-হত্যা: ইতিহাস-বর্তমান)
অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য

প্রচ্ছদের ছবি : অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য
প্রচ্ছদ রূপায়ণ : সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য : ৩৯০ টাকা

সুপ্রকাশ 

Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম। বাগাল গুরুর পাঠশালা

এক যে ছিল গ্রাম। ডাকাতি

অলৌকিক বাগান।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।।