বীরেশ্বর সামন্তর হত্যা রহস্য।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।।
অবশেষে ভোর এল। তার রং ছিল মাছের শুকনো কাঁটার মতো ফ্যাকাশে। এবং কুয়াশা, যা সম্ভাবনাময়, তার পেট ফেটে রক্তের মতো চুঁইয়ে নামল আলো আর হুম হুম শব্দে অমোঘ শূন্যতাকে পায়ে ঠেলে মেঠোপথ বেয়ে জনা কুড়ির দল ইটভাটার চিমনি লক্ষ্য করে এগিয়ে গেল। আকাশে কোলাহল ছিল আর নাবালক মেঘে ছিল আস্ফালনের সম্ভাবনা। জীবন যেন নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিল আর চমকপ্রদ শব্দাবলি কুচো পাপড়িদের মতো ঝরছিল চরাচরে, নদীতীরকে জ্যান্ত লাগছিল। ছন্নছাড়া পাখিগুলো তাদের বাসা ভুলে যাবার প্রস্তুতি নিল, আর দিগন্তছোঁয়া বলখেলার মাঠ জুড়ে সোঁদা বাতাস বইলে বর্ষণ সম্ভাবনায় সন্ত্রস্ত হলো চরাচর। পুরুষদের লুঙ্গি হাঁটুর ওপর পাট করে গুটিয়ে রাখা আর বয়স্কদের মাথায় ছিল মাঙ্কি ক্যাপ, অকৃপণ হিমে তাদের চামড়া কুঁচকে গিয়েছিল বলে কাঁপুনি দূর করার জন্য মুখ থেকে আরও জোরে হুম হুম আওয়াজ তুলে প্রায় দৌড়ের ছন্দে পা ফেলে আর কাহিল জন্তুর থরথরানির মতো কাঁপে কুয়াশার চাদর, ঝোপঝাড় তখন ভিজে চুপচুপে। দলটা বিহার থেকে এসেছিল আর তাদের সবথেকে অল্পবয়স্ক মেয়েটা বুঝতে পারছিল যে তার সঞ্চারিত গর্ভকে ক্রমে লুকিয়ে রাখা যাবে না অন্যদের থেকে, যেহেতু বাড়তে থাকা পেটকে কাপড়ের কষি দিয়ে দাবানো অসম্ভব। অসময়ে হিসি পাবার প্রবণতা বাড়লে নিজেকে তার ছন্নছাড়া লাগে আর দাঁতে দাঁত ঘষে তলপেট চেপে রাখায় সে খুঁজে পায় কাঁপা শরীরের রক্তদ্রুম। সে তখন বিস্ময়ভরা চোখ নিজের শরীরে রাখে এবং চিনতে শেখে উপবাসের চিহ্ন। ইটের পাঁজা বয়ে নিয়ে যেতে পেশির আড়ষ্টতা অথবা আচমকা মাথা ঘুরলে গলার কাছে ঠিকরে আসা বমিকে আবার গিলে ফেলার মুহূর্তে এ মর্মগহীন তাকে স্থিতি দেবে আর মুখমন্ডলকে দেবে একাকীত্ব, এমনটাই মনে হতেও পারত। কিন্তু কামিনের কাজ ক্লিন্ন হে, সে অগোছালো ভেবেছিল। তবু চিবুক শক্ত করে সে এগিয়ে যাচ্ছিল মাঠ পেরিয়ে নদীর ধারে যে ইটভাটা আর তার গম্ভীর চিমনি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া চরাচরকে মালিন্য দেয় প্রতিদিন, সেদিকে লক্ষ রেখে তলপেটে চিনচিনে হিসির বেগ অগ্রাহ্য করবে ভেবেছিল। সে ভেবেছিল চোখ বন্ধ রাখবে তার দিকে ইদানিং অধিক নজর দেওয়া হেডমিস্ত্রির লালাসিক্ত হাসির দিকে, এমনকী সামান্য দূরে কুয়াশা ভেদ করে অস্বাভাবিক দুলতে থাকা পিন্ডটাকেও সে গুরুত্ব দিতে চায়নি। এভাবে শূন্যে যে কিছু ঝুলতে পারে না আর রাত্রিবেলা হলে সাদা কাপড়ে আবৃত বস্তুটাকে অপদেও ভাবা যেতেও পারত, আর এমনকী তার মজফফরপুরের গাঁওদেশে যে এমন ভূতপ্রেতদানোর দাপাদাপি আকছার, সবটুকু জেনেও মুঠোতে হৃৎপিণ্ড আঁকড়ে অভিভূত মেয়ে বুকে চিবুক গুঁজল, সে দৃঢ় নিঃশ্বাসে পেরতে চাইল শীতের মাঠ। কিন্তু দলটা তখন থমকে দাঁড়াল কারণ এবার দৃশ্যটা সম্যক প্রতিভাত হলো সবার কাছে। বৃদ্ধরা তাদের পিচুটি পড়া চোখ উঁচুতে মেলে ধরল আর মাঙ্কি ক্যাপের ভেতর থেকে ঘড়ঘড় আওয়াজ বেরোলে তা ভয়ের না বিস্ময়ের বোঝা গেল না, কারণ মাঠের মাঝখানের ঝুরি নামানো বটগাছ ততক্ষণে লাফিয়ে একদম মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে, আর তার নিচু ডাল থেকে ঝুলছে গলায় দড়ি বাঁধা দেহটা। তার পরনে কাদামাখা পাজামা ছিল, ছেঁড়া পাঞ্জাবি, এমনকী মুখেরও এখানে-ওখানে কাদা লেগেছিল। তার বিস্ফারিত চোখের নিচ থেকে বাকি মুখটাকে রবারের মতো আড়াআড়ি লম্বা বানিয়েছিল একটা হাসি, যা দন্তিল ও ক্রুঢ়। কিছু মাছি ভনভন শব্দে ঘুরছিল আর মৃদু হাওয়ায় ডান থেকে বামে দেহটা পাক খেলে মাছির দলও ভেঙে যাচ্ছিল, তারা ফিরতি আক্রমণ করছিল ক্রুদ্ধ শব্দে। কিন্তু গর্ভিণী মেয়েটা ভয় পায়নি কারণ সে গলায় দড়ি অপঘাত মৃত্যু আগেও দেখেছে। তার আবার হিসি পেল, তার তখন নাকে এল গুয়ের গন্ধ, আর সে মাছিদের উদ্দেশ্য বিষয়ে নিশ্চিত হল।
..............................................
বীরেশ্বর সামন্তর হত্যা রহস্য
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
মুদ্রিত মূল্য : ৪৮০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment