বাঘাচাঁদের কথাকাব্য।। অনিল ঘোষ।। সুপ্রকাশ।।

বাইরে একটানা মানুষের ডাক, আকুল কান্না। বাঘাচাঁদ থাকতে না পেরে সকলের অলক্ষে, গোপন পথে বাইরে বেরিয়ে আসে। দেখে এক নতুন বাদা। আই ব্বাস, এ তো চেনা যায় না গো! হায়-হায়, আমার সাধের বাদার কী দশা হইল গো! বাঘাচাঁদ অনেক কষ্টে সটান উঠে দাঁড়ায়। কুড়াল তুলে হাঁক পাড়ে—

এ কোন দ্যাশে আইলাম গো চিনিতে না পারি
বাদার দ্যাশে অ্যামুন সাজ ক্যামনে হইল জারি।
গাঁ-গঞ্জ কমনে গেল, কমনে গেল আবাদ
ঘুণের বাসা বেধিছে র‍্যা, করিবে বরবাদ।

হাঁকডাকের বদলে বাঘাচাঁদের গলা দিয়ে যা বেরিয়ে আসে, সেটা এককথায় গোঙানি। তাই শুনে হাড়হাভাতে মানুষজন, যারা বাঘাচাঁদের কাছে আর্জি জানাতে এসেছিল, তারা ঘুরে তাকায়। সরোষে বলে, অ্যাই, তুই কেডা রে?

বাঘাচাঁদ বলে, আমি বাঘাচাঁদ, বাদার দেশের রাজা। তোরা এই বেড়া ভেঙি ফ্যাল, আমি বলতিছি।

অমনি হাসির ঝড় ওঠে চারদিক থেকে, এই নাকি বাঘাচাঁদ, দুর-দুর—।

হ্যাঁ বাবা, ওরা কেউ বাঘাচাঁদকে চিনতেই পারল না। বরং ব্যঙ্গ করল, বিদ্রুপ করল। ওদের আর দোষ কী! দীর্ঘকাল অদর্শনে বাঘাচাঁদ সম্পর্কে মনে মনে একটা মূর্তি তৈরি হয়ে গেছে। তার সঙ্গে বাস্তবের বাঘাচাঁদের কোনও মিল নেই। তাই হাসি ছাড়া আর কী! হো হো হাসির ঝড় বইতে থাকে চারদিক জুড়ে। হাসি বড়ো ছোঁয়াচে। একবার শুরু হলে মড়ক লেগে যায় যেন। হো-হো-হি-হি-হা-হা চলছে বাদার রাজ্য জুড়ে, ওরে শালো দেখে যারে, বাদায় আইছে নকল এক বাঘাচাঁদ। ধর শালোকে মার শালোকে—।

কী বলব বাবা, এ যে দুঃখের কথা, লজ্জার কথা। বাদার রাজা বাঘাচাঁদ এক লহমায় তুচ্ছ হয়ে গেল বাদারই মানুষজনের কাছে। ওরা ব্যঙ্গ করল, বিদ্রুপ করল। কেউ থুতু ছেটাল, কেউ আবার লাঠি নিয়ে তেড়ে এল মারতে। বাঘাচাঁদকে কেউ পাত্তাই দিল না। সকলের মুখ চোখ ওই বেড়ার দিকে ফিরল। ওই যে ওড়ে সাদা নিশান—ওই দিকে। ওই দিকে মুখ ফিরিয়ে আকুল স্বরে প্রার্থনা করে চলল—

ও বাঘা প্রাণের বাঘা একবার দেখা দাও
বাদা গেল বেহাত হয়ে কুড়াল তুলে নাও।
তুমি রাজা বাদার রাজা এবার দাও হাঁক
যত আছে পোকামাকড় পিলে ফেটে যাক।

প্রার্থনা চলছে আকুল স্বরে। কান্নাকাটির সুরে। দেখতে দেখতে মানুষজন আসছে নানা দিক থেকে। আরও আরও মানুষ, অনেক দূর গাঁ-গেরাম থেকে। হাড়-হাভাতে মানুষজনের গলায় একটাই কথা— বাঘাচাঁদ হে, দ্যাওতা হে, দেখা দে বাপ, আঙগা বেপদ থে রক্ষা কর বাপ—।

আর বাঘাচাঁদ! সে কী করল? বাদাভূমের আপন পরম মানুষের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের চড় চাপড় খেয়ে মনের দুঃখে বনে গেল। সেখানে আছে বনের রাজা। সে তো তবু চিনবে। তার সঙ্গে মোলাকাত খুব জরুরি। যেখান থেকে এই বাদার শুরু, সেখানেই ফিরতে হবে। নইলে বাদা বাঁচানো যাবে না। বাদার মানুষ বাঁচবে না।
............................................................
বাঘাচাঁদের কথাকাব্য
অনিল ঘোষ
.................................
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত

মুদ্রিত মূল্য : ২৮০ টাকা
সুপ্রকাশ
         



Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম। বাগাল গুরুর পাঠশালা

এক যে ছিল গ্রাম। ডাকাতি

অলৌকিক বাগান।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।।