লেটার প্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত অনন্ত জানার বই 'লেটার প্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা’  পড়ে মতামত জানিয়েছেন সুপ্রিয় ঘোষ। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
..............................................................................
অনন্ত জানার 'লেটার প্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা’  

গোলাপি মলাটের বর্ণপরিচয়-এর সঙ্গে যখন প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে তখনই ছাপা অক্ষরের ভূত আমার ভবিষ্যৎ হয়ে ওঠে। তারও আগে বইপত্র যা দেখেছি সেগুলোর ছবি দেখা ব্যতিরেকে ছেঁড়ার সামগ্রী বলে মনে হয়েছে। দুই মলাটের মাঝে অগাধ লিপি সাঁতরে যে জ্ঞান অর্জন করতে হয় এবং এই বস্তুটিকে যে বই বলে—তা সব জানা হলো কালক্রমে। কৌতূহলী শিশু মনের প্রশ্ন এলো এ বই তৈরি হয় কেমন করে? মেজদাকে খুঁচিয়ে জেনেছিলাম ছাপাখানার কথা। তার পর ইতিহাস বইতে পড়া মুখস্থ করেছি—ছাপাখানার জনক হলেন গুটেনবার্গ। তারও পরে যখন পাশের গ্রামের হাইস্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হলাম সেই গঞ্জ এলাকায় যে পথে যেতাম নানান বিপণীর পাশে দেখতাম একটা দোকান। কালিঝুলি মাখা কতগুলো টেবিল, চেয়ার, কেস, আর সেলাই মেশিনের চাকার থেকে বড় আকারের চাকাওয়ালা একটা যন্ত্র। এক ভদ্রলোককে দেখতাম ঐ মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে এক হাতে সাদা কাগজ দিয়ে আর হাতে তুলে নিচ্ছেন মসি লিপ্ত কাগজ। বন্ধুরা বলতো লেখা ছাপা হচ্ছে। ভদ্রলোককে মাঝে মাঝে দোকানের সামনের বেঞ্চে কী সব শুকোতে দিয়ে বসে থাকতে দেখতাম। আর মনে মনে গুটেনবার্গ বলে সম্বোধন করতাম। এক বন্ধু ওদের দোকানের হালখাতার নিমন্ত্রণ পত্র দিলো আমাকে। যেখানে ওদের দোকানের নাম, ওর বাবার নাম সব ছাপা আছে। ও জানালো আমাদের ঐ গুটেনবার্গ ছেপে দিয়েছেন। ওখানে নাকি দোকানের রশিদ, বিভিন্ন ধরনের নিমন্ত্রণের কার্ড, বিল বই এমন কী বই ও ছাপা হয়। আজ ত্রিশ বছর পর সে দোকান আর নেই। কবেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আমাদের সেই  গুটেনবার্গ এখন বৃদ্ধ বয়সে চা বিক্রেতা। 

বহুদিন পর আজ এসব কথা মনে এলো একটা অদ্ভুত বই-এর অনুষঙ্গে। অনন্ত জানার লেখা  'লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা’। বই না বলে ছাপাখানার বাইবেল বললেও অত্যুক্তি হবে না। কম্পোজিটরদের নিয়ে বাংলা ভাষায় একখানা পুরো বই! এটিই সম্ভবত একমাত্র। লেটারপ্রেসের যুগের ছাপাখানার একটা প্রতিনিধি স্থানীয় চিত্র ধরা পড়েছে এই বইয়ের ছাপা অক্ষরে। এবং লেখক সেটি করেছেন ছাপাখানা আর তাকে জড়িয়ে থাকা একটি একান্নবর্তী পরিবারের যাপন বৃত্তান্তকে অনুসরণ করে। লেখক অনন্ত জানা তাঁর অগ্রভাষে লিখেছেন— 'উপন্যাস, নিবন্ধ, সন্দর্ভ, অর্থনৈতিক বা সমাজ নৈতিক অধিকার আলোচনা, স্মৃতিগদ্য-পারিবারিক বর্ণনাপঞ্জী— এই রচনাকে কী নাম দেওয়া হবে তা স্থির করা সহজ নয়।' বইটি পড়লেই এ-দাবীর সত্যতা প্রকট হয় । নানান নামের চৌদ্দটি অধ্যায়ে লেখক সাজিয়ে দিয়েছেন যেমন গ্যালির উপর নামিয়ে রাখা হয় কম্পোজ করা ম্যাটার। এই বইয়ে আখ্যানের সূত্র খুবই সরবে, এবং বইটির অসামান্য হয়ে ওঠার পেছনে এই আখ্যান অংশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও আমার মতে এই বইটি শেষ পর্যন্ত ননফিকশন। অথচ ইতিহাসের অন্তর্বস্তুকে বলার জন্য সরাসরি ভাষ্যের পরিবর্তে এভাবে যে বলার একটা আঙ্গিক হতে পারে, তা বাংলা ভাষায় প্রকৃতই অভিনব, এবং অনুসরণীয়ও বটে। তবে অনুসরণ করা আদৌ সহজসাধ্য নয়, তা বইটি পড়লেই  মালুম হবে। লেখক প্রায় সমান্তরালে একদিকে ঐতিহাসিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিহাস, একইসঙ্গে প্রায় একটি আখ্যানও লিখেছেন। এই দুই বিষয়ে একসঙ্গে কোনো লেখকের অধিকার আদপেই সহজলভ্য নয় এই সময়। 

ষোড়শ শতকের শেষ দিকে পর্তুগিজদের হাত ধরে ভারতবর্ষের গোয়াতে প্রথম ছাপাখানা আসে। দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন ভাষায় প্রথম গ্রন্থ ছাপা হয়। তার প্রায় দুশো বছর পর ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে হাল হেডের 'গ্রামার অব দ্যা বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ' এর মাধ্যমে বঙ্গদেশ ছাপাখানার স্পর্শ লাভ করে। অনন্ত জানা তাঁর তন্বিষ্ঠ পাঠে তুলে এনেছেন কলকাতা সহ সমগ্র বঙ্গদেশ তথা ভারতবর্ষের ছাপাখানার ইতিবৃত্ত। তার ব্যাপ্তি। সময়ের পরম্পরা। হিকি সাহেব থেকে গঙ্গা কিশোর, কাঙাল হরিনাথ থেকে দাদা ঠাকুর, চার্লস উইলকিনস থেকে পঞ্চানন কর্মকার, শ্রীরামপুর মিশন থেকে ফোর্ট উইলিয়ামের কথা। পাশাপাশি কলকাতার বটতলা থেকে শুরু করে কর্নাটকের গদাগ ছাপাখানার ভৌগলিক বিস্তারকেও ঠাঁই দিয়েছেন আলোচনার বৃত্তে। গদাগকে কেন্দ্র করে এসেছে ফকীরসার মত কিংবদন্তি কম্পোজিটরের কথা।
 
লেখক অনন্ত জানা তুলে এনেছেন লেটার প্রিন্টিং প্রেসের শ্রম-খতিয়ান আর শ্রম-সংগ্রামের কথা। একটি প্রেসের টাইপ সেটিং, প্রুফ তোলা, প্রুফ সংশোধন, ছবি বা ব্লক স্থাপন, পেজ মেকআপ এবং সেগুলি মেশিনের স্থাপন এই ধরনের নানান কাজে বহু মানুষের প্রয়োজন হতো। এরমধ্যে টাইপসেটার বা কম্পোজিটররায় ছিলেন প্রধান। এসব কাজে যেমন দক্ষ কর্মীরা থাকতেন তেমনি থাকতেন অনেক অপটু নবীশ। যাদের শিখিয়ে পড়িয়ে পটু করে তোলা হতো। আমেরিকান সাহিত্যের জনক মার্ক টোয়েন, ব্রিটিশ কিংবদন্তি বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন এর মত মানুষেরা একদা লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর ছিলেন, কীভাবে কম্পোজিটররা রাজনৈতিক চেতনায় সে দেশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, তা লেখক দেখিয়েছেন। আমাদের দেশের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে প্রায় উপেক্ষিত কম্পোজিটরদের রাজনৈতিক চেতনার ইতিহাসও যত্ন সহকারে প্রকৃত ঐতিহাসিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখিয়েছেন অনন্ত। 

লেখক দেখিয়েছেন ১৯০৫ সালে কলকাতায় ভারত সরকারের প্রেস এবং বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েট প্রেসের কর্মীদের ধর্মঘটে মুখ্য ভূমিকা ছিল কম্পোজিটরদের। ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে সে ঘটনার প্রভাব কতটা ব্যাপক, তাও লেখক দেখিয়েছেন। তবু এই বইটি অসামান্য হতে পেরেছে, সম্ভবত তার আখ্যান অংশের সূত্রের জন্য। সেখানে এসেছে এক বৃহৎ পরিবারের কথা,যে পরিবার পুরুষ-পরম্পরায় প্রায় শতবর্ষ ব্যাপী লেটার -প্রিন্টিং প্রেসের বা সাধারণ ছাপাখানার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কথকদের কুঠিডাঙার বাড়িটি ছিল প্রকৃতই কমিউন বিশেষ। সেখানে কথকের বড়ো জ্যেঠামশাই আদর্শগত কারণে উচ্চ বিদ্যালয়ের হেডমাস্টারির চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে কম্পোজিটর হতে চেয়েছেন। তার বক্তব্য ' ধরো আমরা হলাম গিয়ে কাঙালের নাতিপুতি। আমরা তো আনন্দেই অক্ষর শিল্পী হতে চেয়েছি। আমাদের দিন ঠিকই চলে যাবে।' মেজ জ্যাঠামশাই প্রেসের সঙ্গে যুক্ত আর পিতা কলকাতায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিদ্যার পাঠ গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকা দপ্তরে কাজ করতেন। পারিবারিক প্রেসটি দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে গেলেও কথকের জ্যাঠামশাইরা ও পিতা কখনোই প্রেসকে ছাড়েননি। কেননা কম্পোজিটরের কাজকে তারা আভিজাত্যের চিহ্ন বলে মনে করতেন। পরের প্রজন্মের কথকের কুটিদিও বেছে নেন প্রেসের কাজ । প্রজন্মের পরম্পরা। প্রসঙ্গত এসেছে বাইন্ডার বুধো বা ঘনা নামক বিচিত্র চরিত্র।

বিশুদ্ধ এক গদ্য শৈলী ধারণ করেছে লেখকের অনন্য বয়ান। সৌজন্য চক্রবর্তীর অসাধারণ প্রচ্ছদটি আলাদা করে উল্লেখ করার। প্রচ্ছদ ব্যবহৃত হয়েছে লেটারপ্রেসের অক্ষর। বইটি যে যত্নে নির্মিত হয়েছে, তা হাতে নিলেই বোঝা যায়। বইয়ের সঙ্গে মানানসই বেশ কিছু ছবি এঁকেছেন সুলিপ্ত মণ্ডল।
................................................................
লেটার প্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা
অনন্ত জানা
সুপ্রকাশ
মুদ্রিত মূল্য : ২৯০ টাকা

                                                     

Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম। বাগাল গুরুর পাঠশালা

এক যে ছিল গ্রাম। ডাকাতি

অলৌকিক বাগান।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।।