খণ্ডপ্রহর।। অবিন সেন।। সুপ্রকাশ।।
শ্রাবণের মাঝামাঝি। তবু বাংলার বুকে বর্ষার আগমনের পদশব্দ শোনা যাচ্ছে না। গত দুই বছর বর্ষণ হয়নি তেমন। শুখা গিয়েছে। ফলে ধানের ফলন হয়নি একেবারে। মানুষ আশঙ্কা করতে শুরু করেছে, ওড়িশার দিক থেকে আকাল এবার বাংলার দিকে সরে আসতে চাইছে। দুই বছরের অনাবৃষ্টিতে সম্পন্ন চাষির ঘরেও ধানের মজুত তলানিতে এসে দাঁড়িয়েছে। গরীব মানুষের অবস্থা তথৈবচ। যারা পারছে ঘরবাড়ি ছেড়ে নগর কলিকাতার দিকে যাত্রা করছে। তাদের ধারণা নগরে বুঝি ঢের সম্পদ, ঢের বৈভব— সেই বৈভবের ছিটেফোঁটা যদি ছিটকে এসে তাদের ক্ষুধার্ত মুখের সামনে পড়ে, তবে তারা বেঁচে যাবে। কিন্তু সে আশা মরুভূমিতে মরূদ্যানের দেখা পাবার মতো। রতিকান্ত বার দুই কলিকাতা ঘুরে এসে দেখেছে মেদিনীপুর, হুগলির গ্রাম থেকে পেটের টানে আসা মানুষদের ঠাঁই হয়েছে নগর কলিকাতার এঁদো অলিতে-গলিতে। কলিকাতা তাদের গ্রহণ করেনি। এহেন এক অনিশ্চয়তার মধ্যেও রতিকান্ত ভাবে তাকে কলিকাতা যেতে হবে। চাঁদ বণিকের মতো তাকে একদিন ভিনদেশি হয়েও কলিকাতা বন্দরে পদার্পণ করতে হবে। সপ্তগ্রাম বন্দরে গঙ্গার জলের কিনারায় বসে ক্রমশ ঘনায়মান অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সে মনে মনে আওড়াল,
ছয় পুত্র লয়ে চান্দ শীঘ্রগতি চলে।
উপনীত হৈল গিয়ে পাটন সিংঘলে।।
নৌকা লাগাইল সাধু সমুদ্রকিনারে।
মনের কৌতুকে সাধু নাম্বিলা সত্বরে।।
রতিকান্ত মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল। এক দল কালো মেঘ যেন ধীরে ধীরে জমাট বেঁধে আকাশকে ভারি করে তুলেছে। রতিকান্তর বুকের ভিতরটা নেচে উঠল। তবে কি বহু কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির দামামা বাজতে চলেছে! খাঁ খাঁ তৃষিত প্রকৃতির বুকে তবে কি এবার একটু বৃষ্টিভেজা বাতাসের ছোঁয়া লাগবে? সে খেয়াল করল, বাতাস যেন থমকে আছে। যেন চরাচর নিশ্বাস বন্ধ করে আগতপ্রায় ঝঞ্ঝার জন্যে অপেক্ষা করছে। বছর তিনেক আগে চৌষট্টি সালের ৫ই অক্টোবর এক প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের মুখে পড়েছিল কলিকাতা। রতিকান্ত তখন কলিকাতায়। তারিণী ঘোষালের সঙ্গে সে সেইবার কলিকাতায় গিয়েছিল। আগের দিন সকালে চাল বোঝাই তাদের একটি জাহাজ ভাগীরথী নদী তীরে নোঙর ফেলেছে। কুলিকামিনদের মাথায় মাথায় চাল নামছে। তারপরে সেই চালের পেটিকা বোঝাই হচ্ছে গরুর গাড়িতে। সে গরুর গাড়ি যাবে বিভিন্ন ইংরেজ ব্যাপারীদের কুঠিতে। সে এক বেজায় ব্যস্ততার অবস্থা। রতিকান্ত দৌড়াদৌড়ি করে সেই সব বিলিব্যবস্থার তদারকি করছিল। তার তখন দম ফেলার সময় ছিল না। সেইদিনও আকাশ বাতাস ছিল থমথমে। সেইদিন সেই আকাশ বাতাসের দিকে তাকাবার ফুরসৎ ছিল না রতিকান্তর। তবে বুড়ো জাহাজি মনিরুল চাচা আকাশের দিকে তাকিয়ে যেন গন্ধ শুঁকছিল। জোরে জোরে শ্বাস টানতে টানতে একটা সূক্ষ্ম মসলিনের বস্ত্রখণ্ড বাতাসের দিকে উঁচিয়ে ধরে বাতাসের গতিপ্রকৃতি লক্ষ করছিল। তারিণী খুড়ো গিয়েছে কোনও এক ইংরেজ ব্যাপারির কুঠিতে। বাকি কর্মচারিরা বেজায় ব্যস্ত। তাই হাতের কাছে কাউকে না পেয়ে রতিকান্তকে ডেকে বলেছিল, ‘বিল কত্তা, একটা কথা কইবার ছিল।’
এখন এই বুড়োর বকবক কে শুনবে! না কার শোনবার সময় আছে। মনিরুল চাচা বুড়ো হয়েছে, ফলে তার কদর গিয়েছে। সবাই তাকে বকবকে বুড়ো বলে। যত বুড়ো হচ্ছে তত যেন তার ভীমরতি বাড়ছে আর বকবক করে বেড়াচ্ছে। নবীন ছেলে ছোকরারা-কর্মচারিরা তাকে এড়িয়ে চলে, পাত্তা দেয় না। জাহাজে এখন নতুন নাবিক। এক ফরাসি ছোকরা নেভিগেটর নিযুক্ত হয়েছে। তার কী হাঁকডাক। তবে তারিণী ঘোষাল কিন্তু বুড়ো মনিরুলের অভিজ্ঞতার কদর করে। তাই তাকে জাহাজে একটা ঠাঁই দিয়েছিল। যদিও মনিরুল বুড়ো ছেলেছোকরাদের থেকে তফাতে থাকে। জাহাজের ডেকে বসে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর বিড়বিড় করে, ‘বাতাস কিন্তু ভালো ঠেকছে না, ঝড় আসতে পারে— সাবধান হো। সাবধান হো।’
তবে তার অনেক গালগপ্প হেসে উড়িয়ে দিলেও এই কথাগুলো কেউ তেমন ফেলতে পারে না। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মনিরুলের ঝড়ের পূর্বাভাস মিলে যায়। আড়ালে তাকে কেউ কেউ ডাকে— ‘ঝড় বুড়ো’। এহেন ‘ঝড় বুড়ো’র কথা শোনবার কোনও ধৈর্য ছিল না রতিকান্তর। তবু কী ভেবে সে দাঁড়াল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘কী বলছ বলো? আমার এখন তোমার গপ্প শোনবার সময় নেই।’
মনিরুল বুড়ো ফ্যাল ফ্যাল করে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, ‘হাওয়ার গতি আমার ভালো ঠেকছে না! আমি ঝড়ের গন্ধ পাচ্ছি।’
এই বলে বুড়ো হাওয়ার দিকে নাক উঁচিয়ে যেন শ্বাস টানতে লাগল। তার এলোমেলো সাদা দাড়ি তিরতির করে কাঁপতে লাগল।
রতিকান্ত তার চোখ মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল। কী যেন ভাবল মনে মনে। তারপরে সে নিজেও যেন বাতাসকে অনুভব করবার চেষ্টা করল। আশ্বিন মাসের নীল আকাশ, ঝলমল করছে রোদ। তবে রোদের তীব্রতা যেন বেশি। শরতের আকাশ যেমন হয়— বকের ডানার মতো সাদা মেঘ ইতিউতি লেগে আছে নীল শামিয়ানার গায়ে। তবু তারও মনে হলো সব যেন কেমন থমকে আছে।
সে ‘ঝড় বুড়ো’র সামনে থেকে সরে গিয়ে দৌড় দিল। হাঁক পাড়তে লাগল, ‘হেই! হেই! জলদি জলদি হাত লাগাও। হাত লাগাও তাড়াতাড়ি। আজ বিকেলের মধ্যেই আমাদের কাজ শেষ করতে হবে।’
সে নিজেও যেন আরও ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করতে লাগল। আশেপাশের জাহাজের থেকে লোকলস্কর জোগাড় করে ফেলল সে। বয়েসে কিশোর হলে কী হবে, রতিকান্ত সেই বয়েসেই অন্যকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেবার বিষয়ে বেজায় উদ্যমী। আর কীভাবে কখন কড়ি ছড়িয়ে কাজ হাসিল করতে হয় তা সে ভালো করে শিখে গিয়েছে।
দুপুরে যখন তারিণী ঘোষাল ফিরে এলো তখন জাহাজ থেকে প্রায় সমস্ত চালের পেটিকা নেমে গিয়েছে। রতিকান্ত তাকে সব বলল। তারিণী মনে মনে তার তারিফ করতে কারতে জাহাজের নাবিকের সঙ্গে কথা বলতে গেল। মনিরুল বুড়োর সঙ্গেও কথা বলল।
‘আজ রাত্রিটা আমাদের সাবধানে থাকতে হবে।’
মনিরুল বলল, ‘আমরা বরং কিনারা থেকে কিছুটা তফাতে গিয়ে নোঙর ফেলি।’
সন্ধ্যের আগেই জাহাজকে যথাস্থানে নোঙর করিয়ে দিয়ে পিটার লরেন্স নামের এক ব্যাপারির হাভেলিতে গিয়ে উঠল তারিণী আর রতিকান্ত। তবে দুর্যোগের কোনও সম্ভাবনা হেসেই উড়িয়ে দিল লরেন্স সাহেব। তারিণী তার সঙ্গে কোনও তর্কে গেল না। কে আর দুর্যোগের অপেক্ষায় থাকে! যাক্, তাদের তো মজবুত একটা হাভেলিতে মাথা গোঁজবার ঠাঁই হয়েছে, এই যথেষ্ট। জাহাজে যে চাল এসেছিল তারও বিলি-ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এখন আশ্বিনের ঝড়ঝঞ্ঝা এলেও তেমন ক্ষতির সম্ভাবনা কম। শুধু জাহাজটার জন্যে একটু দুশ্চিন্তা রয়ে গেছে তাদের।
সন্ধ্যা বা রাত্রিতে কিছু হলো না। ঠিক ভোর হবার মুখে আকাশ জুড়ে মেঘ ছেয়ে এলো। প্রথমে মৃদু বৃষ্টি নামল। তারপরে শুরু হলো প্রবল বর্ষণ। সকাল হলেও দিনের আলো ভালো করে ফুটল না। যত বেলা বাড়ল তত যেন অন্ধকার ঘনঘোর হয়ে এসেছিল। রতিকান্ত আজও মনে করতে পারে, কী সেই প্রবল বর্ষণের তোড়! ঠিক বেলা এগারোটার দিকে আরব্য রজনীর দৈত্যের মতো বিশাল এক ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ল কলিকাতা নগরীর উপরে। কী সেই ঝড়ের তাণ্ডব! তা যেন আর ভালো করে মনে নেই রতিকান্তর। সেই অসীম বিভীষিকাময় সময়ের স্মৃতি যেন তার মস্তিষ্কের অলিন্দে ঝাপসা হয়ে গেছে। শুধু তার মনে আছে থরহরি কম্পমান বিশাল একটা অট্টালিকার একেবারে নিচের তলার এক ঘরের পালঙ্কের নিচে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে সেও দু’চোখ বুজে কাঁপছিল আর ঠাকুরদেবতার নাম করছিল। সেই ঝড়ের গর্জন আর বাড়িঘর ধসে পড়াবার কোনও শব্দ তার কানে প্রবেশ করেছিল কী না তা সে আজ মনে করতে পারে না। কতক্ষণে সেই তাণ্ডব থেমেছিল তাও তার মনে নেই। তবে সারাটা দিন তারা সেই ভাবে ঘরে বসে বসে হরির নাম জপ করছিল।
পরদিন তারিণীখুড়োর সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে দেখেছিল একটা সজ্জিত নগরী যেন বিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। উপড়ে পড়া গাছপালা আর ঘরবাড়ি। মৃত মানুষ আর মৃত পশুপাখি।
সেইদিন তারা জাহাজঘাটে পৌঁছাতে পারেনি। পরদিন সেখানে পৌঁছে দেখেছিল এক লণ্ডভণ্ড চেহারা। পরে জেনেছিল ২১টি জাহাজ একেবারে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। ১৩৯টির অবস্থায়ও ভগ্নপ্রায়। তবে ৩৮টি অল্প ক্ষতির মধ্য দিয়ে রক্ষা পেয়েছে। তাতে জাহাজটিও কিনারা থেকে তফাতে ছিল বলে অল্প ক্ষতির মধ্য দিয়ে রক্ষা পেয়েছিল।
................................
খণ্ডপ্রহর
অবিন সেন
................................
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
মুদ্রিত মূল্য : ২৮০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment