সময়-অসময়ের চালচিত্র।। মিহির সেনগুপ্ত।। নির্মুখোশ শারদ ১৪৩১।।

"সময় অনেকটাই এগিয়ে যাচ্ছিল। আমি যথেষ্ট বয়স্ক, পুরনো ধ্যানধারণার মানুষ। সেকালে দেখেছি, এ অঞ্চলে কি হিন্দু, কি মুসলমান কোনও সমাজেই অনাত্মীয় নারী পুরুষ তা তারা যে বয়সেরই হোক এ রকম, এতটা বা মোটামুটি মুক্তভাবে মেলামেশার কথা ভাবতে পারত না। রহিমারা এতটা সাহস অর্জন কী ভাবে করল? রহিমা বিএ পর্যন্ত পড়েছে। কথাবার্তায় চৌখস। পড়াশোনাও মোটামুটি ভালোই। তার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে বেশ লাগছিল। বুঝলাম, মাসিমা না থাকলেও, তাঁর মানুষ গড়ার ধারাটা লুপ্ত হয়নি, বিশেষত মেয়েদের মুক্তচিন্তায় উত্তীর্ণ করতে। সবটা বা সব স্থানের অবস্থা জানার সুযোগ হয়নি। শুধুমাত্র আমার এই একদার ভূমির এই অঞ্চলটুকুতে যে অগ্রগামিতা লক্ষ করলাম, তা বেশ আশাব্যঞ্জক। রহিমা যে কোনও কথা প্রকাশ করে বলতে দ্বিধা করে না। তবে তার রসিকতার মাত্রাবোধটা মাঝে মাঝে অস্বস্তির সৃষ্টি করছিল। মাঝে মাঝে বুঝতে পারছিলাম না এ ব্যাপারটা তার ব্যক্তিগত স্বভাব-চাপল্য অথবা বর্তমান সমাজে এখানের সার্বিক প্রবণতা। এ অঞ্চলে, সাধারণের বাকবিধি বা আচরণে আমার 'সেকালে' অপরিসীম স্থূলতা ছিল দেখেছি। শিক্ষিত ভদ্র সমাজে, শহর-গ্রামে তাকে 'অসোইব্য কথা' বলা হত। তখন শিক্ষার ব্যাপ্তি একান্তই কম ছিল। কিন্তু এখন তো শিক্ষার হার অনেকটাই বেড়েছে। এখন কেন শিক্ষিত-অশিক্ষিত বা কমশিক্ষিতদের মধ্যে এই স্থূলতার বাড়াবাড়ি?

কিন্তু সেই অস্বস্তির মধ্যেই আবার পড়তে হল। রাত প্রায় যেন আটটা। ততক্ষণে রফিকের আসা উচিত ছিল। সম্ভবত কোনও কাজে আটকে গেছে। রহিমাকে বললাম, 'চল, রফিককে আসতে না-করে দিয়ে আমরা অন্য রিকসা করে হাই-এর বাসায় যাই। রাত হচ্ছে।' রহিমা বলল, 'এহনই আইবে হ্যানে। বউয়ের লইগ্যা এ্যাটটা ভাবনা নাই?'

'মনে তো হয় না।'

মোর কইলোম মজাই লাগতে আছে।

পরপুরুষের লগে গুজগুজ ফুসফুস করণের মজাই আলাদা। তয়, বেশি মজা পাইতাছি আপনের ডরানো দেইখ্যা। আপনের য্যান এ্যাটটা ক্যামন ক্যামন ভাব। অইছে কী? এই তো কয়েন, বুড়া মানুষ, বয়স অইছে। ভাবে তো এমন বুজি না।' এই সব কথার মধ্যে রফিক এসে পৌঁছোয়, রিকসায় হাই বসে। বলে, 'হাই-সাহেব দ্যাহেন, এ তো আপনে আমার সব্বোনাশের ব্যবস্থা করলেন। খাওয়াইলাম, দাওয়াইলাম, আদর আপ্যায়ণ করলাম, এহন আমার বিবিরে লইয়া নদীর পারে আন্দারে হাওয়া খাইতে আছেন।'

হাই বলল, 'তোরে মালাউন কি আর সাদে কই।'

বললাম, 'আমিও কি সাধে যবন বলি।'

নদীর দিক থেকে হাওয়ার একটা ঝাপট লাগে এসে সবার গায়ে। শীতকালের শেষ এখন। সামনে বসন্ত আসছে। নদীর বাতাসটা এ সময় ঈষৎ উষ্ণতায় মাখানো। কিছু অতীত স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বর্তমানের চক্রব্যূহে পড়লাম। আসলে, বর্তমান কিছু নয়, সবটাই অতীত। বস্তুত সবটাই কালের সময় অসময়। বর্তমানের স্থূলতাটা নজরে চট করে পড়ে। অতীতটা মোহময় বলে তার ধাক্কাটা সরাসরি লাগে না। আজ এদের যে-ব্যাপারটা স্থূল বোধ হচ্ছে, কাল সেটা মধুর বলে হয়তো মনে হবে। কাল আবার পুরনো রাস্তা ধরে নদীর সঙ্গে গা-ঘষাঘষি করে নিজের গ্রামে যাব। সেই পথ, ওরা বলছে, এখন নাকি চলা খুব কষ্টকর। কারণ কালকের 'এখনটা' বর্তমানের স্থূলতা। অতীতের মোহময়তাটা তখন পাওয়া কষ্টকরই হবে।" 
......................................................

সময়-অসময়ের চালচিত্র
মিহির সেনগুপ্ত 
.....................................................

নির্মুখোশ শারদ ১৪৩১

অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য : ৩০০ টাকা

আসছে আগামী সপ্তাহে

                

Comments

Popular posts from this blog

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

রাস্তার শুরু।। জয়া মিত্র।। সুপ্রকাশ।।