ভেরনিকা।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।। নির্মুখোশ শারদ ১৪৩১।।

"ঠাণ্ডা আর ধূসর, ভীষণ নীরক্ত সবেমাত্র বিকেলবেলায় সৌভিক চোখ মেলে বুঝল তার বিছানা ঘামে ভেসে যাচ্ছে, ফলত সে মাথা তুলে ফ্যানের ফুলস্পিড আর এসির কুড়ি ডিগ্রি দেখে নিশ্চিন্ত মনে সিগারেট ধরাল। তার মনে আসেনি হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা, বরং খুশি হল, কারণ পরপর দুইবার সার্ভিসের যে লোকগুলো এসে এসি ঠিকঠাক কাজ করছে বলে সার্টিফিকেট দিয়েছে, তারা আসলেই অপদার্থ, সে বুঝেছিল। অফিস শুরু হতে এখনো ঘণ্টা দেড়েক বাকি। সেদিন বিকেল ছিল ছায়াময়, আর বিজয়গড় অগ্রগামী ক্লাবের সামনে আড্ডার বেঞ্চগুলো ইতিমধ্যে পাতা হয়েছিল। জানালা দিয়ে সৌভিকের চোখে পড়েছিল চায়ের দোকানে উনুনে আঁচ পড়ছে আর মাথা নুইয়ে একটা বুড়ো অটো হেলতে দুলতে পল্লিশ্রীর দিকে চলে গেল, তখন সিগারেটের ধোঁয়ারা ঘরের ভেতর জমাট কুয়াশা তৈরি করছিল, সৌভিকের মনে হল এরা তাকে বেশ ঢেকে দিলে হয়, যেন ধোঁয়ার জালের ভেতর সে ঢুকে যাবে, পুরনো দিনের বলিউডি ভূতের ছবিতে যেমন দেখাত। পাশের ঘর থেকে ক্রমাগত দরজা আঁচড়াবার সেই পরিচিত আওয়াজটা আসছিল, কিন্তু সৌভিকের আলস্য লাগছিল বরাবরের মত। ফ্ল্যাটের বাইরে বেরবার তো প্রশ্নই নেই, এই ঘর থেকেও তার বেরতে ইচ্ছে করছে না। বাড়ির বাইরে শেষ বেরিয়েছিল মার্চের চোদ্দ তারিখে, আর আজ পাঁচই এপ্রিল। তার আগে একত্রিশে জানুয়ারি সেক্টর ফাইভের করিমসে টিম লাঞ্চের জন্য বেরতে হয়েছিল, ওহো, সে বিরক্তিকর! অতগুলো লোক অর্থহীন হাসছে, হাউহাউ করে বিরিয়ানি গিলছে, কষ বেয়ে কাবাব রোলের সস গড়াচ্ছে, তার মধ্যে মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে ফুটবল টিম নিয়ে ডেলিভারেবলস নিয়ে তৃণমূল শাহরুখ টেলর সুইফট রামমন্দির নিয়ে—সৌভিকের মনে হয়েছিল সে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে আর তার দুই কানের পাশ দিয়ে সাঁ সাঁ শব্দে ছুটে যাচ্ছে গুলি। শেষবারের মত গায়ে রোদ লাগানো সেই, তারপর অনেকদিন সে ভুলে গেছে ঝনঝনে সূর্যালোকের ভেতর পোকাদের অবাধ যাতায়াত, অথবা চার নম্বর পুকুরে জ্যোৎস্না পড়লে আলোছায়ার কাটাকুটি বিভ্রম যেখানে যতটুকু, এই সবকিছু তার মনে দাগ কাটতে পারেনি সে কতকাল হয়ে গেল। আজও জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছে, ভারতমাতার পুজোর মাঠ যেদিকে, তার মাথা দিয়ে কালো ধোঁয়া বেরচ্ছে, কাঁচ খুললে হল্লার আওয়াজ কানে আসবে বলে তার মনে হল। ওদিকটায় কলকাতা বত্রিশ নামের একটা রেস্তোরা হয়েছে যার চিলি পর্ক অনেকবার অর্ডার দিয়ে আনিয়েছে সৌভিক, আর তার পাশ বরাবর নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষদের পাড়া। পাড়াটা সহজদাহ্য, মাঝে মাঝেই আগুন লাগে। কিন্তু এই তথ্য তাকে কল্পনার জোগান দিল না, উদ্বেগ অথবা। সে এই অঞ্চলে বহুদিন ধরে আছে, আর বহুদিন হয়ে গেল সে কোথাও নেই।"
......................................................

ভেরনিকা
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য
.....................................................

নির্মুখোশ শারদ ১৪৩১

অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য : ৩০০ টাকা
                
আসছে আগামী সপ্তাহে

Comments

Popular posts from this blog

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

রাস্তার শুরু।। জয়া মিত্র।। সুপ্রকাশ।।