লেলানু।। শুভজিৎ ভাদুড়ী।। নির্মুখোশ শারদ ১৪৩১।।
জুলাই মাসের কোনও একদিন
বিকেল ০৫: ৫২
এখন মাথার উপর কেবল একটা মস্ত আকাশ। যতদূর চোখ যায় শুধুই আকাশ। খানিক আগের সব বিচিত্র আকৃতির মেঘপিণ্ড এখন কেমন ম্লান হয়ে গিয়েছে। কেউ যেন তার নিজস্ব আকার ধরে রাখতে পারছে না। একেকটা মেঘপিণ্ড গিয়ে মিশে যাচ্ছে পাশেরটার সঙ্গে। সে তারও পাশেরটার সঙ্গে। আকাশ যেন একটা অনন্ত পট। নির্জনতা প্রিয় কোনও এক শিল্পী তার তুলির টানে ধূসর করে দিচ্ছে সবটা। শেষ কবে এরকম ভাবে আকাশ দেখেছে কেউ, এত অখণ্ড এক অবসর যাপন করতে করতে! অবসর! হাসি পায়! হ্যাঁ, অবসরই তো। অনন্ত অবসর। এখনই তো সময় জীবনের লাভ ক্ষতির হিসেবগুলো কষে নেবার। মনে পড়ে কত কথা। এই অসীম আকাশের নীচে শুয়ে কত কথা মনে পড়ে। আকাশ কি স্মৃতির প্রতিনিধি? কে দেবে উত্তর! কেউ দেবে না! অনুমান করে নিতে হবে। হয়। যেমন কোনওমতে শরীরটাকে একটু নড়িয়ে সে অনুমান করতে পারছে তার প্যান্টের পকেটটা হালকা। ফোন নেই। টাকার বান্ডিলগুলো নেই। টাকা! হাসতে কষ্ট হলেও একটু হাসল সে। এই টাকার জন্য তাকে এককালে কত কথাই না শুনতে হয়েছে...
টাকা কী গাছে ধরে না মাটি খুঁড়লে পাওয়া যায়! বাজার ফেরত টাকা থেকে দশ টাকার কোল্ড ড্রিংক খেয়েছিল বলে জগন্নাথ মণ্ডল কী মারটাই না মেরেছিল লেলানুকে। আসল নাম লেলানু নয়। কিন্তু ছোটবেলায় লোকে তাকে একটু বোকা হাবা মনে করত বলে ল্যালা বলে ডাকত। সেখান থেকে উচ্চারনভেদে লেলা হয়ে শেষপর্যন্ত লেলানু। নামটা টিকে গেল। পোশাকি নাম আছে বটে একটা। তবে দরকার পড়ে না। ছোটবেলার সেই বোকা হাবা ছেলেটা, নিজের বাপ জগন্নাথ মণ্ডলের কাছে কথায় কথায় চড় থাপ্পড় খাওয়া ছেলেটা বড় হয়ে কী আশ্চর্য জাদুবলে বুঝে গেল টাকা গাছে না ধরলেও মাটি খুঁড়লে অবশ্যই পাওয়া যায়। অবশ্য এই বুঝে উঠার পথ সহজ ছিল না। যে বার মাধ্যমিক পরীক্ষায় ইংরেজি আর অঙ্কে ব্যাক এল সে বারেই বাড়ি ছেড়েছিল লেলানু। কিন্তু বাড়ি ছেড়ে করবে কী! ত্রিসীমানায় তার এমন কোনও আত্মীয় স্বজন ছিল না যে তাকে দুবেলা দুমুঠো খেতে দেবে। অগত্যা আমজেদ আলীর হাতে পায়ে ধরতে হল। লেলানু দাদন খাটবে। ও জানত যে আমজেদ দিল্লিতে লেবার পাঠায়।
বছর খানেকের বেশি দিল্লিতে খেটে লেলানু যখন আবার গ্রামে ফিরল তখন তার চেহারায় কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। অক্লান্ত খাটনির ফলে শরীরের মাংসপেশিগুলো আগের থেকে শক্ত আর টানটান হয়েছে। বাড়িতে বেড়া বাঁধার সময় সে যখন খালি গায়ে বাঁশ কাটে তখন যারা তাকে আগে থেকে চিনত তারা লেলানুর চেহারায় বদল অনুভব করে। দিল্লির জল হাওয়ায় কী ছিল কে জানে, বদল কিছুটা হয়েছে লেলানুর মনেও। সে এখন কথা বলে কম। হয়তো সেজন্যই বা ওকে এখন আর অতটা হাবা-গোবা মনে হয় না। মাস দুয়েক বাড়িতে চুপচাপ কাটিয়ে, আমবাগানে মাচায় শুয়ে বসে অলস সময় কাটানোর পর আবার যখন দিল্লি যাওয়ার সময় এল, লেলানু বেঁকে বসল। বাড়িতে জগন্নাথ ওকে কিছু একটা বলতে গিয়েছিল, কিন্তু জগন্নাথের সঙ্গে ও আজকাল বিশেষ কথা বলে না।
এবারে গ্রামে এই মাস দুয়েক মতো থাকতে থাকতেই লেলানুর ভাব হয়েছিল নেহেরুল সেখের সঙ্গে। নেহেরুল চাচা। আগে থেকেই চিনত। গ্রাম তো একটাই। তবে সে বলতে গেলে কেবলই মুখচেনা। নেহেরুলের জমি জমা যেমন ভালই আছে পাশাপাশি এটা ওটা ব্যবসাও আছে। ওর একটা চালু ব্যবসা হল মাটির। এই এলাকায় মাটির ব্যবসা অনেকেই করে। যারাই একটু পয়সাবালা তাদেরই বাড়িতে আছে একটা বা দুটো ট্র্যাক্টর। মাটি পরিবহন বা ভাটা থেকে ইট পরিবহনের কাজে ভাড়া খাটানোর জন্য। তিনটা ট্রাক্টরের মালিক নেহেরুল নিজেও। পাশাপাশি একটা পপলিং মেশিন। যদিও ব্যবসায়ী মানুষ, তবু নেহেরুলের ব্যাপারটা বাকিদের থেকে আলাদা। নেহেরুলের পয়সা পাঁচঘাটের। এখন তো সে আবার পঞ্চায়েতের মেম্বারও বটে। কথাটা নেহেরুলই প্রথম পেড়েছিল লেলানুর কাছে, 'টেকটার চালাইতে পারিস?'
'নাহ', লেলানু বোকার মতো হেসেছিল।
'শুয়ে বসে সময় লষ্ট করছিস ক্যানে? শিখে লে। গাড়ি চালিয়ে তো পয়সা রোজগার করতে পারবি।'
কথাটা খারাপ লাগেনি লেলানুর। মুখের বিস্মিত ভাবটা বজায় রেখেই সে বলেছিল, 'শিখলে তোমার গাড়ি চালাতে দিবা?'
লেলানুকে জমিতে নিয়ে গিয়ে একটা ট্রাক্টরের সামনে দাঁড় করিয়ে নেহেরুল বলেছিল, 'আগে তো শিখ, লে স্টিয়ারিং ধর।'
তখন যারা নেহেরুলের ট্র্যাক্টর চালাত তার মধ্যে একটা ছেলে ছিল প্রবীর। সেই-ই শেখাল লেলানুকে। উঁচু নিচু এবড়ো খেবড়ো অসমান জমির উপর দিয়ে গরগরিয়ে চলল ট্রাক্টরের চাকা। প্রথম প্রথম কয়দিন টলমল করছিল কিন্তু দিনকয়েক যেতেই গাড়ি যেন কথা শুনতে শুরু করল লেলানুর। মজা এসে গেল। সাহস করে খাড়া চড়াইয়ে উঠিয়ে গাড়ি একদিন রাস্তায় নামাল লেলানু। পিছন থেকে চিৎকার করল প্রবীর, 'দেখিস বে মানুষ মারিস না।'
......................................................
লেলানু
শুভজিৎ ভাদুড়ী
.....................................................
নির্মুখোশ শারদ ১৪৩১
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
মুদ্রিত মূল্য : ৩০০ টাকা
Comments
Post a Comment