খণ্ডপ্রহর।। অবিন সেন।। সুপ্রকাশ।।
সবাই বলছে সময়টা এখন খারাপ। সময়টা ঠিক কবে ভালো ছিল, তা মনে করতে পারে না সাত্যকি। সত্যই কি সময় কোনও দিন ভালো ছিল? তার?
শ্যামা বলল, ‘তুমি আজকাল বড্ড ভাবুক হয়েছ। আগে তো এমনটা ছিলে না। কি এতো ভাবো বল তো?’
সাত্যকি ঘাড় ঘুরিয়ে পূর্ণদৃষ্টিতে শ্যামার দিকে তাকাল। শ্যামাকে কি তার আগের থেকে আরও রোগা মনে হচ্ছে! হয়ত শীর্ণ মুখ আরও ধারালো হয়েছে। আরও যেন বেশি করে শ্যামলা মনে হচ্ছে তাকে। ঠিক মেঘলা দুপুরের মতো। কোঁকড়ানো চুল রুক্ষ। টিকালো নাকের উপরে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ভাসা ভাসা চোখের গভীরে ক্লান্তি। সাত্যকি এমনি করে আগে কখনও কি তাকিয়ে থেকেছে শ্যামার দিকে! সে ভাবে। ভাবতে ভাবতে আবার অন্যমনস্ক হয়ে যায়। শ্যামা আজকাল হন্যে হয়ে একটা চাকরির জন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, সাত্যকি ঠিক জানে না। তবে জানে অস্থির শ্যামা অনবরত, অবিরত ঘুরে বেড়াচ্ছে— আস্তাকুঁড় থেকে দেবালয়— কোথায় নয়! মিনিবাস-পাবলিক বাস-মেট্রো প্রতিটা যানবাহন যেন জেনে যাচ্ছে শ্যামার এই দৌড়। সাত্যকি অন্যমনস্ক ভাবে তাকিয়ে থেকে শ্যামার চোখের ভিতরে সেই অসীম ক্লান্তি দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু সাত্যকি নিশ্চিত জানে, একটা ভদ্রগোছের চাকরি কেউ দিতে পারবে না শ্যামাকে। কী যোগ্যতা আছে তার! সামান্য সেকেন্ড ক্লাস বিএ। আজকাল শুধু এই কোয়ালিফিকেশন নিয়ে চাকরি হয় না। সাত্যকি আবার শ্যামার মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখল। শ্যামা কি সুন্দরী? সাত্যকি জানে সুন্দর আর অসুন্দরের সীমারেখা বড্ড ঠুনকো কিংবা অলীক। তবে কি শ্যামা অসুন্দর? সে নিজের মনে মাথা নাড়ে, না তা কেন হবে—শ্যামার রূপ গভীর জলাশয়ের মতো— ডুব দিলে তবে তার থই পায় কেউ। কেউ? কেউ মানুষটি আবার কে? বড়ো রহস্যময় ভাবে সাত্যকি এই কেউ এর শূন্যস্থানে নিজেকে বসিয়ে ফেলে আর তখনই তার পিপাসা পায়। গলার ভিতরে কেমন একটা অলীক ইচ্ছা জলহীন শুষ্কতায় তাকে জানান দেয়। সে পকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে। এহেন এই এতশত ভাবনার ভিতরে খেয়াল করেনি শ্যামা তার দিকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। সামনে গঙ্গা। অনেকদিন পরে তারা আবার গঙ্গার ধারে এসে বসেছে। ভাঁটার টানে জল অনেকটা দূরে সরে গেছে। পাড়ের দিকে থকথকে কাদা জেগে উঠে বিকেলের তির্যক আলোয় চিক্্চিক্ করছে। সেইদিকে তাকিয়ে শ্যামার সহসা মনে হলো, একরাশ ধাতব পয়সা যেন ছড়িয়ে আছে। সে লম্বা করে শ্বাস টানল। কোথাও ছাতিমের গাছে ফুল ধরেছে। তার সেই মাদকীয় সুবাস আসছে। পুজো এসে গেল সামনেই। আর কয়েকদিন পরে মহালয়া। শ্যামা ভাবছিল পুজোর আগে আগে একটা যদি চাকরি হয়ে যেতো, তবে বেশ হতো। ভাইটার জন্যে একটা ভালো জামা কিনত সে। কতকাল ভাইকে একটা ভালো কিছু কিনে দিতে পারেনি সে। বস্তির কয়েকটা বাচ্চাকে পড়িয়ে আর কটা টাকাই বা হয়। সেই কটা টাকা প্রয়োজন মেটাতেই ফাঁকা হয়ে যায়— বিলাসিতা করবার সামর্থ্য কোথায় তার! অনেক কষ্ট করে প্রাইমারি টিচারের ট্রেনিংটা করতে পেরেছিল সে। দু’বেলা টিউশনি করে কিছু দিয়েছে সে। মায়ের জমানো টাকার সঞ্চয় ভাঙতে হলো। মা তার বিয়ের জন্যে তিল তিল করে সেই সব জমিয়েছে। নিবেদিতা এই টাকা ভাঙতে একেবারেই রাজি ছিল না। কিন্তু শ্যামা তাকে বুঝিয়েছিল, স্কুলে একটা চাকরি পেয়ে গেলে, টাকাটা উঠে আসতে সময় লাগবে না মা! তাছাড়া তোমার এই হতকুচ্ছিত মেয়েকে কে বিয়ে করবে বলো তো!
নিবেদিতা কী বলবে! মেয়ের প্রতি তার অঢেল বিশ্বাস। অঢেল প্রশ্রয়। তাছাড়া সে দেখতে পাচ্ছে মেয়েটা চাকরি চাকরি করে কেমন হন্যে হয়ে আছে। সে নিজেও বিশ্বাস করে মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। সে নিজের জীবনের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। একটা প্রাইভেট স্কুলের অশিক্ষককর্মীর চাকরি তার। এই সামান্য কটা টাকায় তিনটে পেট চালাতেই হিমসিম খেয়ে যেতে হয়। দুটো টাকা রোজগারের জন্যে কী অপরিসীম পরিশ্রম করে মেয়েটা। বস্তিতে ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েদের পড়িয়ে কতটুকু রোজগার হয়! কেউ মাইনে দেয়— কেউ অনিয়মিত— কেউ আবার দেয় না! মেয়ের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নিবেদিতা ভাবে, এই অল্প বয়েসেই মেয়ের চেহারায় যেন বয়সের ছাপ পড়ে যাচ্ছে। শ্যামা তার মায়ের এই মনোবেদনার কথা জানে। বুঝতে পারে। মাঝে মাঝে নিজেকে সে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেখত। এখন আয়নার সামনে দাঁড়াতে তার কুৎসিত লাগে। কেন কুৎসিত লাগে তার? সে কি আর কোনও প্রিয় মানুষের চোখ দিয়ে আয়নার ভিতরে নিজেকে দেখার বিলাসিতা করে? সভয়ে সে আয়নার সামনে থেকে সরে আসে। আয়নার সামনে থেকে নিজেকে লুকিয়ে ফেলার এক উদগ্র বাসনা তাকে গ্রাস করে। সভয়ে তার মনে হয় সেই মানুষটি কি সাত্যকি? একটা সুপ্ত বাসনা তার মনের আকাশে উঁকি দিয়ে ফের কালো মেঘের আড়ালে যেন লুকিয়ে পড়ে। এই মেঘ যে কি সে ঠিক বুঝতে পারে না। শ্যামা যেন খেয়াল করে দেখল পশ্চিম আকাশে অস্তগামী সূর্যের আলোর কাছাকাছি তেমনি একটা মেঘ ভেসে আছে। সেই মেঘ আর আগত অন্ধকারের ভিতরে আলো কেমন গভীরভাবে নিমগ্ন হয়ে যাচ্ছে।
সাত্যকি কি এই সব অলীক কথা বুঝতে পারছে?
তার মুখের দিকে তাকিয়ে সেইকথাই যেন উপলব্ধি করবার অবকাশ খোঁজে শ্যামা। সাত্যকির মুখের উপরে তেরছা ভাবে একটা লালচে আলোর আভা লেগে আছে। সে অন্যমনস্ক ভাবে সিগারেট টানছে। বাতাসে এক মুখে ধোঁয়া উড়িয়ে দিয়ে সাত্যকি আবার শ্যামার মুখের দিকে তাকায়। দেখতে পায় শ্যামার চোখে কেমন এক বিস্ময়ের দৃষ্টি। ঠিক যেন ভোরের টগর ফুটেছে।
শ্যামা বুঝতে পারে সাত্যকির মনের ভিতরে কোনও কথা নেই। কিন্তু শ্যামার এখনই উঠে পড়তে ইচ্ছা করছে না। সে চাইছে আরও কিছুক্ষণ এমনি করে সাত্যকির দিক তাকিয়ে সে বসে থাকে। তবু তার এতো নৈকট্যের কাঙাল হওয়া সত্ত্বেও মাঝে মাঝে সাত্যকির প্রতি একটা হিংসার বোধ মনের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে ওঠে। একসময়ে তারা বেশ ছিল বস্তিতে প্রতিবেশি। তাদের মধ্যে অবস্থার সীমারেখাটা ছিল সূক্ষ্ম। সেখান থেকে সাত্যকি হঠাৎ করে হয়ে গেল কোনও এক জমিদার বংশের উত্তরাধিকারী। শ্যামা ভাবে মানুষের জীবনে এমনও ঘটে! এমন সিনেমায় দেখা যায়— গল্পে শোনা যায়— নিজের চোখে এই প্রথম দেখল সে। সাত্যকি বস্তির এঁদো ঘরের জীবন ছেড়ে বৈভবের জীবনে ঢুকে পড়ার পরে অনেকদিন তার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। তারপরে আবার সেই ম্যাজিক। অলক্ষ্যে বসে থাকা কোনও এক ম্যাজিশিয়ানের যাদুর খেলায় যুবক সাত্যকিকে আবিষ্কার করে শ্যামা।
শ্যামবাজারের মোড়ে বাস ধরবে বলে শ্যামা দাঁড়িয়েছিল। সেদিন খুব গরম পড়েছে। তীব্র রোদ আর গরমে যেন ঝলসে গিয়েছিল সে। ক্লান্তিতে তার শরীর যেন নুয়ে আসছিল। তখনি বাসস্টপে একটা গাড়ি এসে থামল। ক্লান্ত চোখ তুলে শ্যামা খেয়াল করল এক মহিলা তাকে ডাকছেন। শ্যামা গাড়ির জানলার কাছে এগিয়ে গেলে বিন্ধ্যবাসিনী বলেছিল, ‘তুমি শ্যামা না! ঠিক চিনেছি তো!’
শ্যামা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। টিভি সিরিয়ালে দেখা আশ্চর্য সুন্দর মহিলাদের মতো এই প্রৌঢ়াকে সে কি কোথাও দেখেছে? সে ঠিক মনে করতে পারে না। তবুও তার যেন তখনই মনে হয় কোথাও সে দেখেছে এই মহিলাকে!
শ্যামা ঘাড় নাড়লে বিন্ধ্যবাসিনী আবার বলেন, ‘তুমি আমাকে দেখেছো। আমি সাত্যকির বিন্ধ্যমা।’
শ্যামা চমকে উঠেছিল। মনের গভীরে যে নাম একদিন থিতিয়ে গিয়েছে, সেই নাম যেন হঠাৎ কোনও অভিঘাতে ভেসে উঠল। মানুষ জানে না কোথায় কোন মানুষের জন্যে তার মনের ভিতরে অধিকারের ডিক্রি জারি হয়ে আছে। যখন বুঝতে পারে তখন আপনা থেকেই সেই মানুষটার প্রতি এক নিবিড় মায়া জেগে ওঠে। শ্যামা বড় স্বার্থপরের মতো সাত্যকিকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইল। কেন? সে ঠিক তা জানে না। শ্যামা মাঝে মাঝে ভাবে, সাত্যকিটা যেন কেমন। কোনও কাজকর্মের চেষ্টা নেই। গ্র্যাজুয়েশন যেমন তেমন করে পাশ করে বসে আছে। বিন্ধ্যমা তাকে কত করে বলেছে পড়াটা চালিয়ে যাবার জন্যে। শ্যামা জানে। শ্যামাকে ডেকে কতবার বলেছেন, ‘তুই তো সত্যকে বোঝাতে পারিস, পড়াটা সে এমন করে ছেড়ে দিল কেন!’ অথচ একসময়ে সাত্যকির যা পড়াশুনায় মাথা ছিল! অঙ্কের সূত্র আর সমাধান যেন তার পায়ের কাছে পোষা সারমেয়র মতো অনুগত হয়ে থাকত। কিন্তু সেই সাত্যকি কিছুই করে উঠতে পারল না। শুধু ভাবুকের মতো বসে থাকে। অযথা ভবঘুরের মতো ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ায়। ঢোলা প্যান্ট আর গায়ে চেপে বসা টি-শার্ট। কোনোদিন পাইস হোটেলে খেয়ে দুপুরের রোদে কয়েক কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হেঁটে চলে যায়। কোনোদিন শ্যামার সঙ্গে দেখা হলে— অবশ্য শ্যামাই তার সঙ্গে দেখা করে বা দেখা করতে গেলে অদ্ভুত সব কথা বলে। কিংবা কোনও কোনোদিন নিশ্চুপ বোবার মতো বসে থাকে।
সাত্যকির সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছিল। দগ্ধ টুকরোটিকে আঙুলের টোকায় দূরে নিক্ষেপ করে দিয়ে শ্যামার দিকে তাকায়। তার চোখের সামনে যেন অযথা একটা বিরক্তির বোধ জেগে ওঠে। খুব বিশ্রী ভঙ্গিতে সে বলে, ‘তোমার কি আর কোনও জামা নেই? প্রতিবার দেখি একটাই জামা পরে আছো?’
শ্যামা একটু যেন অবাক হয়। সে নিজের ঘাড় নুইয়ে নিজের দিকে তাকাবার প্রয়াস করে। তার পরনে হলুদ খোলের উপরে নীল ফুল ফুল কুর্তি। সুতির নীল ওড়না। নতুন না হলেও পরিচ্ছন্ন। শ্যামা জানে এই কুর্তিতে তাকে ভালো মানায়। এবং এই নয় যে, এই কুর্তি পরে রোজ রোজ সে সাত্যকির সামনে আসে। সে বুঝতে পারল না সাত্যকির বিরক্তির কারণ। তার মুখের দিকে ডাগর চোখ তুলে তাকাল। আলো এবার বেশ কমে এসেছে। সেই মরা আলোয় সাত্যকির চোখের আয়নায় সে নিজেকে যেন দেখবার চেষ্টা করল। এই সময়ে বেশ হাওয়া দিচ্ছে। খুস্ করে বটগাছের থেকে কয়েকটা অলস শুকনো পাতা উড়তে উড়তে জলের দিকে চলে গেল। দূর থেকে ভোঁ বাজল জাহাজের। আশেপাশে আরও দু’একজোড়া তরুণ-তরুণী নিবিড়ভাবে বসে আছে। সে দেখল সাত্যকির চোখে বিরক্তির এক কুটিলতা এলোমেলো হয়ে লেগে আছে।
সে সেই বিরক্তির ভ্রুকুটি ভঙ্গিতে বলল, ‘চলো, একবার নিমতলা শ্মশানঘাটে যাবে?’
শ্যামা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। সাত্যকি ঘাড় নাড়তে নাড়তে বলল, ‘থাক তবে আজ।’
তারপরেই অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, ‘তোমার একটা চাকরির খুব দরকার, তাই না?’
শ্যামা আধো অন্ধকারের মধ্যেও মুখভঙ্গি করে বলল, ‘বাব্বা, তোমার আবার এই সব বিষয়ে খেয়াল থাকে নাকি!’
শ্যামার কথাটা শেষ হতে না হতেই সাত্যকির কাছে সমস্ত বিকেলটা ভীষণ তিক্ত আর বিস্বাদ মনে হলো। শ্যামাকে কেমন বিশ্রী আর স্বার্থপর মনে হলো। সে ঝট করে উঠে দাঁড়াল। দায়সারা ভঙ্গিতে বলল, ‘চলো।’
তারপরেই শ্যামার অপেক্ষা না করে নিজেই হন হন করে হাঁটা লাগাল।
............................
খণ্ডপ্রহর
অবিন সেন
............................
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
মু্দ্রিত মূল্য : ২৮০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment