বিপ্লব হারানোর শহরে ছায়ামহলের কথা।। শিলিগুড়ির হারানো সিনেমা হল।। সৌমিত্র ঘোষ।। নির্মুখোশ শারদ ১৪৩১।।

"আমাদের ছোটবেলা, অর্থাৎ কিনা ষাটের শেষ, সত্তরের মাঝামাঝি। সে সময়ে সিনেমা দেখা খুব সহজ কিছু ছিল না। বাড়ির বড়রা সিনেমায় যেতেন, সুতরাং বাড়িতে ও পাড়ায়, তৎসহ কাগজের পাতায় সিনেমার কথা, বিজ্ঞাপন, ছবি। নিছক সিনেমা নিয়ে একাধিক জনপ্রিয় পত্রিকার আনাগোনা ছিলই বাড়িতে, উল্টোরথ, প্রসাদ, জলসাঘর ইত্যাদি, পরে আনন্দলোক। বোঝাই যায়, পরিস্থিতি ও পরিবেশ সিনেমা-অনুকূল ছিল। কিন্তু সে বড়দের, বা বখে যাওয়া স্কুল পালানো ছোটদের জন্য। দু'দলের কোনটাতেই পড়তাম না, সিনেমা দেখবার সুযোগও হতো না। বড় হওয়ার আগে, মানে ইস্কুল ছেড়ে কলেজে পা দেওয়ার আগে, অর্থাৎ শিলিগুড়ির মফস্বল ছেড়ে সত্যিকারের কলকাতা শহরে পাড়ি দেওয়ার আগে পর্যন্ত, সিনেমা হলে ঢোকার সুযোগ হয়েছে খুব কম। খুব মাঝেমধ্যে, কালেভদ্রে যে দু'একটা সিনেমা ছোটদের দেখার মতো বিবেচিত হতো, ছাড়পত্র মিলতো শুধু সেগুলোই দেখার, নইলে লবডঙ্কা। বলা বাহুল্য, খুব সুখের ছিল না ব্যাপারটা। ইস্কুল ও পাড়ার বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই কী করে যেন টাকা বা পাস জোগাড় করে সিনেমা দেখতে চলে যেত! চুলোয় যাক স্কুল বা বাড়ি! নতুন হলে লাগা 'বই' নিয়ে লাগাতার কথা বলার শেষ নেই যেন, যাকে আজকাল বলে সঘন চর্চা। 'বই দেখলি কাল?' উত্তেজিত উত্তর আসে, 'দেখলাম! ম্যাটিনিতে! আরি স..সাইট! ধর্মেন্দ্রর কী ফাইটিং! গানগুলাও পুরা হিট! পরের বইটাও শালা দেখবোই! বচ্চন আছে!' আমাদের মতো 'বাড়ির কথা শোনা ভালো ছেলে' জাতীয় দুর্ভাগাদের কাছে এসব আলোচনা বড় মনোকষ্টের কারণ হতো বিলক্ষণ। তবু না শুনেই বা যাব কোথায়? সিনেমা তো! 

সিনেমা দেখবার জায়গা বা হল বলতে সেসময় সর্বমোট তিনটেই। এক, আমাদের পাড়ায় টাউন স্টেশনের পিছন দিকে, পুরোনো ও যারপরনাই ধূসর গুদামগোছের একটা লম্বাগোছের বাড়ি, যেটাকে বলা হতো 'নিউ সিনেমা'। দুই, শিলিগুড়ির মূল বাজারএলাকা হিলকার্ট রোড, সেইখানে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলে কিছুটা উন্নত মানের 'মেঘদূত সিনেমা'। এই দুটো হলেই মূলত ও মুখ্যত বাংলা বই লাগতো। এবং যেহেতু পাড়া বা বাজারে পরিচিত লোকের আনাগোনা বেশি, কেউ দেখে ফেলে বাড়িতে বলে দিতে পারে বলে, বন্ধুরা ওমুখো হতো কম। সবাই বই দেখতে যেতো বর্ধমান রোডের পিছনে, মহানন্দা নদীর পাড়ে, 'ঝঙ্কার' হলে। সেখানে হিন্দি বইই লাগতো বেশি। সেকালের রেওয়াজ মতো, হলে নতুন বই লাগলেই, পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতে থাকতো ধুমসো প্ল্যাকার্ড লাগানো রিক্সা। রিক্সার মাথায় লাগানো মাইকের চোঙে হতো ঘোষণা :

আজ সে ঝঙ্কার সিনিমা কী রুপালি পর্দে পর চালু হো রাহা হ্যায় ধর্মেন্দর, শশীকলা ঔর মীনাকুমারি কী অমর প্রেম কাহানি, ফুল ঔর পাথর! (একটু থেমে, আরও কায়দায়, গলা উঠিয়ে নামিয়ে) আইয়ে দেখিয়ে, ফুল ঔর পাথর!

কখনও অন্য সিনেমার ক্ষেত্রে ঘোষণায় শোনা যেত আরও অন্যান্য হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দেওয়া নাম। শোনা যেত, ধর্মেন্দর..র..র..র! দি..লী..প কুমার! (আবারো থামা, গলা বদল), ফাইটিংমে, প্রাণ! ড্যান্স, মিস হেলেন! সঙ্গীত, রোশন! আইয়ে দেখিয়ে...

যদ্দুর মনে পড়ে, সব হলেরই আলাদা আলাদা রিক্সা ছিলো। রিক্সা থেকে ছড়ানো হতো হ্যান্ডবিল। সঙ্গে চলতো গান এবং ঘোষণা। আমাদের নিতান্তই বাঙালি পাড়ায় বসবাস ছিল দু-চার ঘর অবাঙালি পরিবারেরও। সেরকম এক পরিবারের এক রীতিমতো সুদর্শন সন্তান, ডাক নাম বাবুয়া ছিল স্টার অ্যানাউন্সার! সে অদ্ভুত কায়দায় গলা উঠিয়ে-নামিয়ে ঘোষণা! বাবুয়ার নিজের রিক্সাও ছিল বোধহয়। যাই হোক, বাবুয়া রিক্সা নিয়ে পথে নামলেই পাড়ার বাচ্চারা দৌড় শুরু করতো রিক্সার পিছনে। হলে বই লাগা মানে এমনিতেই এলাহি একটা ব্যাপার। এইসব শুনতে শুনতেই সিনেমা দেখা হয়ে গেল একদিন। অবশ্য সিনেমা হলে গিয়ে নয়। সেসময়ের যা রেওয়াজ, ইস্কুলে বা পাড়ায় পর্দা টাঙিয়ে, সরকারি ছবি দেখানোর দল দেখাতো বিভিন্ন নিউজ রিল ও দেশাত্মবোধক ছবি। এটাকে বলা হতো 'পাবলিসিটি'। পাড়ার মেয়েদের ইস্কুলের মাঠে এরকম পর্দা পড়ল একদিন। এটা-ওটা দেখানোর পর শুরু হলো সিনেমা। কী ছিল সিনেমাটা? সম্ভবত 'পথের পাঁচালি'। প্রথম সিনেমা দেখার আনন্দ-উত্তেজনা ডুবে গেল গল্পের কষ্টে। বাড়ি ফিরেছিলাম মন খারাপ করে। 

সিনেমা হলে ঢোকার আগেই সিনেমা কী করে দেখায় খানিক বোঝা হয়ে গেল। পাশের বাড়িতে থাকতো আমার প্রাণের বন্ধু, তারা অনেক ভাইবোন। সারাক্ষণ হইচই তাদের বাড়িতে। ভাইবোনদের মধ্যে সবচাইতে বড় কেশবদা, আলো বিদ্যুৎ সেসবের যন্ত্র, এ নিয়ে জানতেন না এমন কিছু নেই। তালঢ্যাঙা রোগাটে চেহারার মানুষ, লম্বাপানা মুখ, হাসিহাসি মুখে পান চিবুতেন, যন্ত্রপাতি নিয়ে খটখট করতেন, ফি ভোটের সময় গম্ভীর মুখ করে ভোট গুনতেন—অর্থাৎ কিনা সিপিএম দলের কাউন্টিং এজেন্ট হতেন। ভাইবোনেরা অবশ্য দারুণ ভয় পেতো। সে যা হোক, একদিন ওদের বাড়ি গিয়ে দেখি বেজায় মোচ্ছব চলছে। বাড়ির সবাই তো আছেনই, সেই সঙ্গে আশপাশের বাড়ির মেলা লোকজন। কী হচ্ছে? ভাইয়া গম্ভীর মুখে বললো, সিনেমা দেখানো হবে। সিনেমা? বাড়িতে? বলে কী? হাঁ করে দেখলাম, কেশবদা একটা বিদঘুটে গোছের যন্ত্র এবং বিস্তর তার-টার নিয়ে কী একটা করছেন। উঠোনে গাছপালার ফাঁকে সাদা পর্দা টাঙানো। যন্ত্রটার মাথার দিকে দুটো চাকা মতোন জিনিস ঘরঘর ঘটঘট আওয়াজ তুলে ঘুরছে। নীচে ত্রিপল বিছানো, তার ওপর আরও অনেকগুলো ওইরকম চাকা রাখা।

কিছুক্ষণ ঘুরে-টুরে যন্ত্রের চাকা থেমে গেলে দেখি চাকার মধ্য থেকে লম্বা সরু ফিতের মতো কী একটা বেরুচ্ছে তো বেরুচ্ছেই। কেশবদা খুব ব্যস্ত হয়ে সেগুলোকে কোনোক্রমে ধরেপাকড়ে চাকায় ভরছেন সেগুলো। ওমা, যন্ত্র থেকে চাকা খুলে নেওয়া হলো, কেশবদা ফিতে চোখের সামনে ধরে কী যেন দেখলেন অনেকক্ষণ ধরে। আমরা কাছে গিয়ে দেখি কালো নয়, বরং ছাইরঙ প্লাস্টিক গোছের কিছু। তার ওপর আবছা ছবি দেখা যাচ্ছে, লোকজন বাড়িঘর। একই ছবি বারবার। ভাইয়া বললো, ছিঁড়ে গেছে! কী ছিঁড়লো? ভাইয়া আবার বললো, সিনিমা। ওইটা হইলো সিনিমার মেশিন। দাদা মেরামত করতেছে। কেশবদা অনেক কিছু করেন, তার মধ্যে সিনেমা হলের কাজও, জানতাম। কিন্তু কী কাজ সেটা জানতাম না। বাড়িতে এসে বড়দের জিজ্ঞেস করায় বোঝা গেল, চাকা ঘোরা বিদঘুটে যন্ত্রটাকে বলে প্রজেক্টর, সেটা দিয়ে সত্যি সত্যি সিনেমা দেখানো হয়। ফিতের মতো জিনিসটাকে বলে ফিলিম। কেশবদা তখন নিউ সিনেমা বা মেঘদূতের প্রজেক্টরগুলোর দেখভাল করতেন, দরকার মতো চালাতেনও। চালাতে চালাতে ফিল্ম ছিঁড়ে যায়, সেগুলোকে তখন জুড়তে হয়। এসব শুনেটুনে তো, ব্যস! ভাইয়াদের বাড়ি থেকে নড়ি না, কেশবদার পাশে ঠায় বসে থেকে প্রজেক্টর দেখি, আর ছেঁড়া ফিল্মে হাত বোলাই, চোখের সামনে তুলে ছবি দেখবার চেষ্টা করি। কবে, কতদিন পরে মনে নেই, মেশিন ঠিক হলো। বোধহয় সে উপলক্ষেই, বাড়ির উঠোনে পর্দা বেঁধে কেশবদা একটা গোটা সিনেমা দেখিয়ে ফেললেন। সে সিনেমার নাম 'জাগৃতি'। হিন্দি ছবি অথচ ছোটদের দেখার মতো, পাড়া বেপাড়ার বাচ্চাবুড়োর ভিড়ে বাড়ির ঘর উঠোন ভরে গেলো। গল্পটা আবছা মনে আছে। পরে জেনেছিলাম, সত্যেন বসু মশাইয়ের ছবি, ওই গল্প নিয়ে প্রথমে 'পরিবর্তন' বলে একটা বাংলা ছবি হয়, পরে হিন্দি। অনেকজন্ম আগের কথা সব, যাঁরা জানেন না, তাঁদের জ্ঞাতার্থে বলে রাখি, সত্যেন বসু সেসময়ের ফিল্ম জগতের দিকপাল বিশেষ, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে তাঁর তৈরি 'বরযাত্রী' ছবি দেখেননি, এমন দর্শক ছিলেন না।"

......................................................

বিপ্লব হারানোর শহরে ছায়ামহলের কথা
শিলিগুড়ির হারানো সিনেমা হল

সৌমিত্র ঘোষ
.....................................................
নির্মুখোশ শারদ ১৪৩১
বিশেষ ক্রোড়পত্র : বাংলার হারিয়ে যাওয়া সিনেমা হল

অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য : ৩০০ টাকা



Comments

Popular posts from this blog

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

রাস্তার শুরু।। জয়া মিত্র।। সুপ্রকাশ।।