আহাম্মকের খুদকুড়ো।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত দুর্লভ সূত্রধরের বই 'আহাম্মকের খুদকুড়ো' পড়ে ইন্সটাগ্রামে মতামত জানিয়েছেন দিশা চক্রবর্তী। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
...........................................................
বই : আহাম্মকের খুদকুড়ো
লেখক : দুর্লভ সূত্রধর
প্রকাশনা : সুপ্রকাশ
মুদ্রিত মূল্য : ৩০০/-

সাধারণের তুচ্ছ জীবনের চারপাশেও চঞ্চলতা- ঔদাস্যের কত দিন জমা হয়ে থাকে খুদকুড়োরই মতো। ডুমাটোলার দাদু বলেছিলেন, " বুঝলে দাদুভাই, এই জীবনটা ছাড়া জীবনে অপ্রয়োজনীয় বলে কিছু নেই।"

সমগ্র বই জুড়ে লেখক এঁকেছেন তার অতীত জীবনের, ছোটোবেলার গল্প। সকালের জলখাবারের রকমারি থেকে শুরু করে জ্বরের মুখে পোড়ের ভাত আর রহস্যময় ঘি-এর স্বাদ, সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা প্রস্ফুটিত হয়েছে লেখকের কলমে। কখনো আবার একসাথে গোটা একটা ডিম খাওয়ার প্রথম ও রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা লিখেছেন লেখক। জলখাবারের সমারোহ কখনো কখনো গভীরভাবে আকর্ষণ করতো লেখককে। লেখকের লেখায় লেখকের ছোটোবেলার জীবনের আরো অনেক তথ্য ধরা পড়ে। লেখকের স্কুল, রিপাবলিক স্কুল, স্কুলের শিক্ষক, স্কুলের বন্ধুরা, সরস্বতী পূজা, উদযাপন উপলক্ষে বিভিন্ন কাজ-কর্মসূচী, স্কুলে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নাটক, বিজ্ঞান প্রদর্শনী সবকিছু ঘটনা পড়তে পড়তে কোথাও কোথাও গিয়ে মনে হচ্ছিল আমি নিজে ওই সময়ে, এবং ওই ঘটনাগুলোর মধ্যে উপস্থিত আছি। একটি অধ্যায়, নাম 'পিঁপড়ে পোষা, ইলনারতত্ত্ব' যে অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাই নারকেল ও ইলিশ মাছ নিয়ে লেখকের বন্ধু অমৃতের আগ্রহ, ভালোবাসা ও বিভিন্ন গবেষণামূলক পদের নাম। সরস্বতী পূজার পর দোল উৎসব নিয়েও বেশ কয়েক পাতা লিখেছেন লেখক। দোলের দিনের কর্মসূচী, দোলের আগের দিনের ন্যাড়াপোড়া, ন্যাড়া পোড়ার তাৎপর্য পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল আমি নিজে লেখকের ছোটোবেলার সময়কালের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে রয়েছি। দোলযাত্রার মতোই আরও একটি উৎসবের বর্ণনা লেখকের লেখায় ফুটে উঠেছে, এবং সেটি হল ঝুলন। 

এরপরেই লেখক বর্ণণা করেছেন বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ যুদ্ধ ও যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি, এবং লেখকদের সংগ্রাম। যুদ্ধ ক্রমে শান্ত হয়। এবং যুদ্ধ সম্পর্কে আলোচিত অধ্যায়ের পরের অধ্যায়ে আমাদের সাথে পরিচয় ঘটে প্রণবদা, নীতা, ছন্দিতার। বাবার কড়া শাসনে থাকতে থাকতে নীতা নিজের পছন্দের ছেলেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে নেয়, নীতা ও ছন্দিতার দাদা চাকরী পেয়ে বাবা-মার সঙ্গ ত্যাগ করে, এবং এই এতগুলো ধাক্কা সামলে উঠতে না পেরে নীতা, ছন্দিতার বাবা মৃত্যুবরণ করেন। বাবার ক্রিয়াকর্মের পর মাসখানেকের মধ্যে ছন্দিতাদের পরিবারটি বাড়ি বিক্রি করে চলে যায়। ওরা চলে যাওয়ার পর সবকিছু একই থেকে যায়, শুধু যে প্রণবদা শিক্ষিত হওয়ার পরেও কোনো চাকরী না করে পাড়ার সর্বজনীন মঙ্গল সাধনে নিজেকে সোঁপে দিয়েছিল, সকল কাজে, সকল জায়গায় যে প্রণবদার অবাধ বিচরণ ছিল, সেই প্রণবদা কোথা থেকে একটা বাহারী ফেজ-টুপি জোগাড় করে সেটা মাথায় চাপিয়ে বেশি বেশি করে ঘুড়ি ওড়াতে লাগলো। আর একটি ছেলে, যার সাদামাটা জীবনে পুঁজি -পাটা ছিল কম, তবু কী করে যেন ছন্দিতা নামের সেই মেয়েটির মুখে ফুটে না ওঠা দুঃখের রেখা সে পড়তে শিখেছিল। সেই ছেলেটিই একমাত্র বুঝতে পেরেছিল 'বেদনার পরম গোপন কথা খানি যে কথা কাউকে বলা যায়না, কারোর সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় না।'

এরপরেই লেখক বর্ণনা করেছেন লেখকের একটু বড়ো বয়সে বই-এর প্রতি আগ্রহ জন্মাবার কথা, বই পড়ার কথা, লাইব্রেরী থেকে বই আনা, মায়ের কাছে বায়না করে লাইব্রেরী সদস্য হওয়া, মায়ের থেকে পূজোয় পাওয়া পূজা বার্ষিকী গোগ্রাসে পড়ে ফেলা, খাটের তলায় লুকিয়ে বসে একটানা "পথের পাঁচালি' পড়ে ফেলা, দৌড়ে লাইব্রেরী গিয়ে বই পাল্টানো, বই-এর ভাঁজে লুকিয়ে গল্পের বই পড়তে গিয়ে বাবা-কাকা, দিদিদের হাতের পিটুনি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কিশোর রচনা সমগ্র, শ্রীকান্ত, রামের সুমতি, লালুর গল্প, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আম-আঁটির ভেঁপু, চাঁদের পাহাড়, আরণ্যক, খগেন্দ্রনাথ মিত্রের ভোম্বল সর্দার, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের তুঙ্গভদ্রার তীরে ইত্যাদি বই পড়তে পড়তে যা পাই তাই পড়ে ফেলি, রূপেশ্বরী নদীর প্রতি ভালোবাসা সবটুকু পড়তে পড়তে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিলাম।

এই বইখানি পড়তে পড়তে কত অজানা অচেনা গল্প মনের কাছের হয়ে উঠেছে, পুরনো দিনের গল্পগুলো মন ছুঁয়েছে। অনেক অজানিত অনুভবের কথায় ভরা থাকে এই বইয়ের অবিন্যস্ত পৃষ্ঠাগুলি। সবশেষে বইয়ের প্রচ্ছদ, লেখনী, লেখার ধারাবাহিকতা সবটুকু বিশেষ নজর কেড়েছে। ভবিষ্যতে লেখকের আরো অনেক লেখা, অনেক বই পড়ার ইচ্ছে রইলো।

Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম।। অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। সুপ্রকাশ।।

চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে।। অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।