অভিমানভূম।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

'তৃতীয় দিন বা খুন্টাও মাহা সহরায় পরবের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিন। 'গরু খুঁটা' বা কোথাও কোথাও 'বাঁদনা' নামেই হিল্লোল ওঠে মানভূমের বুকের কোণায় কোণায়। নিয়ম-আচার শুরু হয় সকাল থেকেই। গ্রাম প্রধান এবং নাইকের থেকে অনুমতি নিয়ে শুরু হয় পুজোর কাজ। 'গরু খুঁটা' আসলে গৃহপালিত গরুগুলোকে এবং 'কাঁড়া খুঁটা' চাষের কাজে সাহায্যকারী বলদগুলোকে উত্যক্ত করা। যদিও উদ্দেশ্য শুধু সেটুকুই কেবল নয়। আসলে বর্ষাকালে চাষবাসের পর মাঠে ভর্তি যখন ফসল, তখন দীর্ঘদিন অলস হয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না পশুগুলোর। তাই শীতকালীন চাষবাস শুরু হবার আগে গতরে একটু তাগদ ফিরিয়ে আনতেই এই পদ্ধতি।

এই দিন গরু বা বলদগুলোর শিংয়ে পড়ে তেল-সিঁদুরের প্রলেপ। তারপর তাদের সাজিয়ে দেওয়া হয় ধানের শীষ দিয়ে। গান গাইতে গাইতে শরীরে ছড়িয়ে দেওয়া হয় ধান, নরম ঘাস এবং আতপ চাল। এরপর তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের পাশের কোনো মাঠ বা খালি জায়গায়, যেখানে আগে থেকেই মাটির মধ্যে গর্ত করে শক্ত করে পুঁতে রাখা হয়েছে একটা শাল গাছের গুঁড়ি বা খুঁটি। সেই গরু বা বলদটাকে সেই খুঁটির সঙ্গে বাঁধবার পর তাকে উত্যক্ত করা শুরু হয় ধামসা-মাদল-বাঁশি বাজিয়ে। তীব্র রোষে সেই খুঁটির চারপাশে জুড়ে তখন ঘুরতে থাকে প্রাণীটা। আরো বেশী উত্যক্ত করবার জন্য তার মুখের কাছে ধরা হয় মৃত কোনো গরু বা বলদের শুকনো চামড়া। রাগে উন্মাদ হয়ে এবার তার সামনের মানুষটাকে শিং দিয়ে আঘাত করতে ছুটে যায় দড়িতে বাঁধা গরু। নিখুঁত দক্ষতায় তখন তার সামনে থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে হয় খেলোয়াড়কে। খেলোয়াড়ের মুনশিয়ানায় চারপাশ থেকে ওঠে সাবাশির কলরব। মোটামুটি তিনবার চলে এই বিপজ্জনক খেলা বা প্রথা। এরপর দড়িতে বাঁধা প্রাণী ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিলে, তাকে উদ্দেশ্য করে গাওয়া হয় অহিরে গান। এই গান আসলে এইসব প্রাণীদের সম্মান জানানোর মন্ত্র, যারা সারা বছর সাহায্য করে চাষে বা ক্ষেতের কাজে।

এরপর বেলা বেড়ে চললে এই প্রাণীগুলোকে পৌঁছে দেওয়া হয় তাদের গোয়ালে এবং নাচ-গানে মেতে ওঠে ছেলেমেয়েরা। উচ্ছ্বাসের পরিমাণ বেড়ে ওঠে আরো, কারণ এই দিন থেকেই উৎসবে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে গ্রামের মেয়েরাও। সুঠামদেহী সাঁওতাল যুবকের বাজনার তালে তালে এঁকেবেঁকে ওঠে কালো মেয়ের শরীর। তাদের হাতের মধ্যে থাকে অন্য মেয়ের হাত। এক লয়ে পড়তে থাকা তাদের পায়ের তালে তালে লাল ধুলো ঢেকে ফেলে যেন হেমন্তের মানভূমের আকাশ।

এই দিন সকালে আমন্ত্রিত মেয়ে বা বোনের স্বামীকে একটা নতুন কাপড় উপহার দেওয়া দস্তুর মেয়ের বাড়ির তরফে। নতুন কাপড় বলতে, সাধারণত ধুতিই। সম্মান জানিয়ে তাঁকেই অনুরোধ করা হয় শাল গাছের গুঁড়িটাকে দাঁড় করানোর জন্য গর্ত খোঁড়ার কাজটা শুরু করতে। গরু খুঁটা অনুষ্ঠানের পর কোনো কোনো গ্রামে শুরু হয় গ্রামের পুরুষদের ব্যক্তিগত কোনো দক্ষতা দেখানোর খেলা। লালচে মাটির চত্বর যেন আচমকাই আকাশের নীচে 'যেমন খুশি তেমন খেলো'র খোলা মঞ্চ তখন। গ্রাম প্রধানের ডাকে এগিয়ে এসে হাতে লাঠি তুলে নিলে চাবুকের মতো যুবক, যেন বিদ্যুৎ চমকে ওঠে তার ঘূর্ণিতে। সন্ধে যত রাত্রির দিকে এগিয়ে চলে, উৎসবের রেশ বাড়তে থাকে ততই।
...............................................
অভিমানভূম
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী

প্রচ্ছদ : সন্দীপ রায়
অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল
মুদ্রিত মূল্য : ৩৫০ টাকা
সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম।। অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। সুপ্রকাশ।।

চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে।। অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।