যেসব গল্প ছোটো থেকে বড়ো হয়।। অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।।

'সেদিন যখন দিদি আমার সঙ্গে না পেরে আমাকে ছাড়াই ইস্কুলে চলে গেল তখন মা রান্নাঘরের বারান্দায় পিঁড়ি পেতে বসে পান্তা ভাত ঘোল দিয়ে মেখে নুন ও শুকনো লঙ্কা ভাজা দিয়ে খাচ্ছিলেন। পান্তা ভাত আর ঘোল কাকে বলে সেটা এই গল্পের শেষে তোমাকে বুঝিয়ে বলছি দাদুভাই— তো মায়ের মাখা খাবারে অমৃতের স্বাদ থাকে। আমি বললাম— এক খাবল দাও। 

মা একটার পর একটা গ্রাস আমার মুখে তুলে দিতে দিতে লেখাপড়া শেখার উপকার বোঝাতে শুরু করলেন। সেই পান্তার স্বাদেই বোধ হয়, আমার মনটা গলে গেল। অকুতোভয়ে মাকে বলল,—তাইলে ইস্কুলে চলে যাই?

মা বললেন,—সবিতা যে চলে গেল!

আমি বললাম,—আমি একাই যেতে পারি।

মা বোধ হয় ছেলের বীরত্বে, বিশেষত পড়াশুনার প্রতি তার এমন জাগ্ৰত আগ্রহে আপ্লুত হয়ে আমাকে একাই ইস্কুলে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে দিলেন।

রোজকার চেনা জায়গায় একা একা বিচরণ এক কথা, আর আধ চেনা রাস্তায় একা একা যাওয়া অন্য কথা। তার আগে মাত্রই কয়েকদিন দিদির সঙ্গে ইস্কুলে গিয়েছি। সামনে পিছনে ইস্কুলগামী আরও অনেক বালকবালিকা ছিল। কিন্তু সেদিন রাস্তা শুনশান। সময়টা দুপুর হয় হয়। যারা ইস্কুলে যাওয়ার তারা অনেক আগেই চলে গেছে। হাঁটাটা শুরু করেছিলাম বেশ ধীরেসুস্থেই, নির্ভয়ে। কিন্তু যতই এগোই, সাহস কর্পূরের মতো উবে যেতে থাকে। হাঁটার বেগও বেড়ে যায়। বুক দুরু দুরু। আমাদের গ্রাম ও পাঠশালার মধ্যিখানে ঝর্নাডাঙা বলে এক গ্রাম, তার পাশ দিয়ে মাটির রাস্তা মাঝে মাঝে বাঁক নিয়ে এগিয়ে গেছে পাঠশালার দিকে। সেইখানে এক বাঁকের মুখে হঠাৎ-ই একটা সিড়িঙ্গে পানা লম্বা লোক, তার প্রায় ফোকলা মুখে তিনটে বড় বড় কালো দাঁত, রাস্তার ঠিক মাঝখানে যেন আকাশ থেকে নেমে এসে দাড়িয়াবন্ধ খেলার খেলোয়াড়ের ভঙ্গিতে দু'দিকে দু'হাত বাড়িয়ে আমার যাওয়ার রাস্তা আগলে দাঁড়াল। তারপর মুখ ব্যাদান করে অ্যাঁ—অ্যাঁ করে বিকট আওয়াজ করতে করতে ধেই ধেই করে নাচতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে আমার হৃৎপিণ্ডে পাগলা ঘণ্টি বেজে উঠল। শিশুদের বোধ হয় মৃত্যু চেতনা থাকে না। তাই মৃত্যুর কথা হয়তো আমার মনে আসেনি। কিন্তু চকিতে আমার চোখের ওপর কেউ কালো পর্দা ফেলে দিল, পেট থেকে পা পর্যন্ত একটা শিরশিরে অনুভব গড়িয়ে গেল। আমার জীবনে প্রথম সেই আতঙ্কের উপলব্ধি, সঙ্গে একাকিত্বের অসহায়তা। শৈশবে প্রথমবার সেই ভয়াল সন্ত্রাসের মুখোমুখি হয়ে আমি অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের জন্যে নিশ্চল হয়ে গেলেও শরীরের এক আশ্চর্য অনৈচ্ছিক প্রতিক্রিয়ায় লোকটার বাঁ বগলের তলা দিয়ে গলে ইস্কুলের দিকে মরণপণ ছুট লাগালাম। সঙ্গে সঙ্গে ফাঁকা বুকে তামাম বিশ্বের অভিমান জড়ো হল আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে এল কান্নার দমক। সেই অবস্থায় ছুটতে ছুটতে থামলাম গিয়ে ইস্কুলের একেবারে ভেতরে ঢুকে। ছোট পনশয়ের (পণ্ডিত মশায়ের) কাছে গিয়ে যখন হাঁফাচ্ছি আর হেঁচকি তুলতে তুলতে কেঁদে যাচ্ছি, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, —কি রে, কী হয়েছে?

একটা বাচ্চা কীভাবে প্রকাশ করবে তার অতল খাদের মুখোমুখি হওয়ার বোধ! কিছু খুঁজে না পেয়ে সহজাত বোধে গোঁজামিল দিলাম আমি। ফোঁপাতে ফোঁপাতে অন্য প্রান্তে বেঞ্চের ওপর বসে থাকা দিদির দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম; বললাম,— আমাকে ইস্কুলে নিয়ে আসেনি।

—বটে। এই সবিতা, ইদিগে আয়।

দিদি আসতে, যেন আমাকে সান্ত্বনা দিতেই তার মাথায় আলতো করে চাপড় দিলেন তিনি; বললেন,—এবার থেকে রোজ সঙ্গে নিয়ে আসবি।

অনিচ্ছুক ভাইটি হঠাৎ কেমন করে ইস্কুলে আসার জন্যে এমন ব্যাকুল হয়ে উঠল সে কথা ভেবে দিদি কতখানি তাজ্জব হয়েছিল সেটা দাদুভাই, আর কোনও দিন জানা হয়ে উঠল না আমার।'


ভয়
...............
যেসব গল্প ছোটো থেকে বড়ো হয়
অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল

মুদ্রিত মূল্য : ২৩০ টাকা

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।