হিমশীতল রহস্য।। সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়।।

'আজ তাদের প্রোগ্রাম সম্পূর্ণ অন্য জায়গায়। যেতে যেতেই জন গন্তব্যের বর্ণনা করছে। শুনে মনে হল যাওয়া হবে ভাটনাওকূল ন্যাশানাল পার্কে। হিমবাহ বলতে ভূগোল বইতে যা পড়া আছে তা হল কঠিন বরফের চলন্ত বিশাল চাঙড়। খুব একটা বেশি কিছু জানা ছিল না কারোরই। ভাটনাওকূল ইউরোপের বৃহত্তম হিমবাহ। যার থেকে ছোট্ট হিমবাহ ব্রিয়ামারকুরকূল বেরিয়ে এসেছিল। সেই হিমবাহ ভেঙে গলতে শুরু করলে তা পিছিয়ে যেতে থাকে আর তৈরি হয় এক জলাশয়। যাকে বলা হয় গ্লেসিয়ার লেগুন। লেগুন কথার অর্থ তিনদিকে জমি দিয়ে ঘেরা হ্রদ যার বাকি দিক জুড়ে আছে সাগরের সঙ্গে। ওই জলাশয়কে জন্ম দিয়েই তার স্রষ্টা হিমবাহ পেছনে সরতে শুরু করেছে আর লেগুন আয়তনে বাড়তে আরম্ভ করেছে। আজ এর মাপ আঠারো বর্গ কিলোমিটার। কেন্দ্রস্থলের গভীরতা দুশো ষাট মিটার। ওই লেগুনকে আবার আটলান্টিক মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে এক জলধারা।

জিপে একটাও কথা হয়নি। ওখানে পৌঁছে সুযোগ খুঁজছিলেন তিনি। ক্যারোলিনার সঙ্গে সারাক্ষণের যাত্রাপথে কিছুই জানা যায়নি। ভাটনাওকূলে তাদের একরাত্রি থাকার কথা। হোটেল ঠিক হয়ে গিয়েছে। তবে ক্যারোলিনার ঘটনা জানার জন্য মন উদগ্রীব হয়ে আছে। অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য নেই।

ক্যারোলিনার কাছে অনেক কথাই শুনতে হবে। আর তাই সবাইকে এড়িয়ে সুভাষ পুপুলকে নিয়ে এদিকে এসেছেন। ওই হিমবাহ আর আটলান্টিক মহাসাগরকে জুড়ে দেওয়া জলধারার ওপরের সেতুটিতে এখন তারা দাঁড়িয়ে আছেন। আর ক্যারোলিনার মুখে শুনছেন তার বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা। তাদের দেশের হিসেব মত সন্ধে গড়ালেও আকাশে দিনের আলো। সূর্যের আলো কমে যাবে এগারোটা বাজলে।

নিউজার্সির শহর এলাকার বাইরে একটি দোতলা ফ্ল্যাট আছে ক্যারোলিনার। আসলে ওই ফ্ল্যাটেই পরবর্তীকালে বাবা-মার সঙ্গে বাস করেছে ও। দাদা নিখোঁজ হলে আর সেই শক্‌ পেয়ে অকালে মা মারা গেলে ওই ফ্ল্যাটেই বাবার সঙ্গে থেকেছে ক্যারোলিনা। এখন ও একদম একা থাকে।

সুভাষকে ও বলল 'জানো সুভাষ আমার বাবা মা কতদিন মারা গেছেন,তবু তাদের স্মৃতি এতদিন যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম। মানে কিছু অ্যাললবাম আর চিঠিপত্র ছিল আমার কাছে। আজ আমার সেই ভরসাই ভেঙে দিল এক ছিঁচকে চোর। টাকাপয়সা কিছুই নেয়নি। শুধু হাত দিয়েছে আমার ছোটবেলার স্মৃতিতে।'

‘কীরকম?' সুভাষ জানতে চান।

‘আমার যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাগজের সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে বাবা-মা আর আমাদের দুই ভাইবোনের যাবতীয় একক আর সমবেত ফটো। বিভিন্ন সময়ে আমাকে লেখা বাবার চিঠি।”

আবার কথা বলতে বলতে ও বেসামাল হয়ে যায়।

সুভাষকে বলে ‘কী বললে বুঝবে তুমি, ওবাড়িতে আমার আর থাকার এতটুকু ইচ্ছে নেই। যে কোনোদিন ওই ফ্ল্যাট আমি ছেড়ে দেব।’

ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পান না সুভাষ। আসলে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় দক্ষ পুলিশ অফিসার ক্যারোলিনাকে কিছু বলেও লাভ নেই। ও যা ভাববে তাই করবে।

ইয়কুসারলন জলাশয়ের ধারে ফিরে যান তারা। পথে যেতে যেতে চোখে পড়ে ভাটনাওকূলের থেকে ভেঙে আসা বরফের টুকরো লেগুনের থেকে উদ্ভূত জলধারায় ভেসে এসে পড়ছে সমুদ্রে। সমুদ্রের ঊর্মিমালা সেই ভাঙা বরফের টুকরো ছড়িয়ে দিচ্ছে কুচকুচে কালো সৈকতে। কালো সমুদ্রসৈকতের ওপর সেই সাদা বরফের টুকরো হিরের মতো ঝিলিক দিচ্ছে। পেছনের সমুদ্র তার নীল আকাশের প্রেক্ষাপটে ভাসমান বরফখণ্ড বুকে সাজিয়েছে। ভারি অপার্থিব সেই সৌন্দর্য। একটু আগেই নজরে এসেছে হাঁসেরা সাহস করে নেমে পড়েছে লেগুনের জলে। সাঁতার কাটছে সারিবদ্ধ হয়ে।

ভাবছিলেন সুভাষ এখানে অপরাধ তৈরি হয় কীভাবে? সমুদ্রের ধারে হাঁটলে মন আপনা থেকেই শান্ত হয়ে যায় তো। তারপরেও অপরাধী অপরাধ করার কথা ভাবে!

ফিরে এসে দেখেন বাকি সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে দাঁড়িয়ে আছে। জন একা ফোনে বেশ উত্তেজিত হয়েই কথা বলছে। তাদের দেখেই এগিয়ে এলো। ‘এইমাত্র ফোন এসেছিল, দুজন স্টুডেন্টকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।'


হিমশীতল রহস্য
সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ : সুমন্ত গুহ 

মুদ্রিত মূল্য : ২২০ টাকা

#সুপ্রকাশ 

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।